অধিকাংশ কোম্পানি মার্কেটিংয়ের জন্য বিশাল অঙ্কের টাকা খরচ করে থাকে। এটা আমরা সবাই বুঝি যে, মার্কেটিংয়ের জন্য যখন এত এত টাকা খরচ করা হয়, আর এ থেকে তেমন কোন সুফল পাওয়া না গেলে এর জন্য কতোটা হতাশা কাজ করে। আমরা যখন তথ্য গুলো পর্যালোচনা করে দেখি ভুলটা কোথায় ছিলো তখন অবাক হয়ে যাই। অথচ আমাদের পণ্য কিন্তু আসলেই ভালো ছিলো। এখন কথা হল পণ্যে যদি সমস্যা না থাকে তাহলে সমস্যাটা কোথায়?
সমস্যাটা খুব সাধারণ৷ আমরা অনেক টাকা-পয়সা খরচ করে একটা ওয়েবসাইট তৈরি করি। এই প্রজেক্টে অবশ্যই এই বিষয়ে অনেক অভিজ্ঞ ডেভেলপার এবং ডিজাইনাররা কাজ করেছেন। কিন্তু একজন ডেভেলপার বা ডিজাইনার কি সেলস, মার্কেটিং বা ব্র্যান্ডিং নিয়ে পড়াশুনা বা গবেষণা করে থাকেন? তারা কি আদৌ জানেন, কিভাবে সুস্পষ্টভাবে একটি বার্তা দিতে হয় যাতে করে কাস্টমাররা সহজেই আকৃষ্ট হতে পারে?
বিষয়টি হলো, আপনি একটি আইটি ফার্মের সাথে একটি ওয়েবসাইট তৈরির চুক্তি করেছিলেন। তারা আপনার ওয়েবসাইটটি ভালোভাবে তৈরি করে আপনার কাছে হস্তান্তর করেছে। আপনি তাদের পেমেন্ট করে দিয়েছেন, তারা সফলভাবে একটি প্রজেক্ট শেষ করে আনন্দিত হয়। এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু এতে আপনার আসল উদ্দেশ্য সেলস, মার্কেটিং বা ব্র্যান্ডিং হলো কিনা তা নিয়ে কিন্তু এই আইটি কোম্পানি বা এই সংশ্লিষ্ট কারও কোন মাথাব্যাথা নেই।
বাস্তবতা হচ্ছে, দৃষ্টিনন্দন হলেই একটি ওয়েবসাইট পণ্য বিক্রয় করতে পারে না। কিন্তু “শব্দ” বা “কথা” সেটা পারে। যদি আমরা যা বলতে চাই, তা স্পষ্ট করে না বলি, তাহলেতো কাস্টমারদের তা কোনভাবেই আকৃষ্ট করতে পারবে না৷
এই বিষয়ে ডোনাল্ড মিলার তার লিখা বই Building a StoryBrand (বিল্ডিং এ স্টোরি ব্র্যান্ড)-এ খুব সুন্দর ভাবে আলোচনা করেছেন। আপনি যদি একজন উদ্যোক্তা, ব্যবসায়ি বা মার্কেটিং ইন্ডাস্ট্রির একজন হয়ে থাকান অথবা আপনি যদি আপনার প্রতিষ্ঠানের ব্র্যান্ড ভ্যাল্যু তৈরি করতে চান, তাহলে এই বইটি আপনার জন্য আশির্বাদ স্বরূপ। যারাই সেলস, মার্কেটিং বা ব্র্যান্ডিং-এ আগ্রহী তাদের জন্য এই বইটি পড়া অতিব জরুরী। যারা বইটির নাম আগে কখনো শোনেননি বা শুনেছেন কিন্তু পড়েননি, তাদের জন্য আমাদের আজকের এই লেখা।
আমরা অনেকেই ভেবে থাকি বা মনে করি মার্কেটিং মানে হলো যার মাথায় চুল নেই তার কাছে চিরুনি বিক্রি করার কৌশল। তাছাড়া, অনেকেই মার্কেটিংকে মনে করেন শুধুমাত্র পণ্যের বিক্রি বা সেলস বাড়ানোর প্রক্রিয়া।
বাস্তবিক অর্থে মার্কেটিং এক সীমাহীন প্রক্রিয়ার নাম, যার কোনো শেষ নেই। তাই এ বিষয়ে আমাদের প্রতিনিয়তই নিত্যনতুন গবেষণার মধ্য দিয়ে যেতে হয়। আজ আমরা এই বিষয়েই গুরুত্বপূর্ণ কিছু আলোচনা করবো। তো চলুন শুরু করা যাক।
প্রথমেই যেই বিষয়টি আমাদের বুঝতে হবে তা হলো, Building a StoryBrand (বিল্ডিং এ স্টোরি ব্র্যান্ড) বইয়ের লেখক ডোনাল্ড মিলার বলেছেন যে, Maslow’s Hierarchy of Needs এর কোনো একটা Need যদি আপনি আপনার ব্যবসা দিয়ে পুরন করতে না পারেন অথবা কাস্টমারকে আপনার ব্যবসার মার্কেটিং এক্টিভিটি দিয়ে যদি এটা বোঝাতে না পারেন তাহলে কাস্টমারের আপনার পন্য কেনার সম্ভাবনা অনেক কমে যাবে।
আমরা যদি Maslow’s Hierarchy of Needs এর চার্টটা একটু খেয়াল করি তাহলে দেখা যায়, এই পিরামিডের পাঁচটি ধাপ রয়েছে। নিচ থেকে শুরু করলে দেখবেন Physiological, Safety, Love/Belonging, Esteem, Self-Actualization দিয়ে পিরামিডটি উপরের দিকে শেষ হয়।
মিলার এই পিরামিড দিয়ে যেটা বোঝাতে চেয়েছেন, আপনার ব্যবসা এবং ব্যবসার জন্য যে মার্কেটিং আপনি সাধারণত করে থাকেন এই দুটো জিনিসের, Maslow’s Hierarchy of Needs এর যেকোনো একটি অথবা একাধিক ক্যাটাগরি সমাধান করার সক্ষমতা থাকতে হবে।
যদি সরাসরি বা পুরোপুরি সমাধান নাও করেন, আংশিক সমাধান করার বার্তা আপনি আপনার কাস্টমার পর্যন্ত পৌঁছাতে পারেন, তাহলে আপনার প্রোডাক্ট অবশ্যই বিক্রি হবে। আর যদি আপনার ব্যবসা এই দুটোর একটিও কাস্টমারকে বুঝাতে ব্যর্থ হয়, তাহলে আপনার প্রোডাক্ট কিংবা সার্ভিস বিক্রি হওয়ার সম্ভাবনা খুবই কম।
দ্বিতীয় যেই বিষয়টা তিনি বলেছেন, Simple is Always Better. খুব সস্তা একটা লাইন শোনায় তাইনা? মনে হয় এর আগে কত শুনেছি কিন্তু এই লাইনটার বেশ কিছু চমৎকার উদাহরণ বইটিতে দিয়েছেন তিনি। একটা উদাহরণ এরকম, বহুবছর আগে যখন মনুষ্য জাতি গুহা থেকে বের হচ্ছিলো তখন তাদের একটাই চিন্তা ছিল, কিভাবে বেঁচে থাকার লড়াইয়ে টিকে থাকা যায়। একটা দিন, দুইটা দিন কিভাবে বেঁচে থাকা যায়, সিংহের–বাঘের হাত থেকে কিভাবে নিজেদের বাঁচানো যায়। এভাবে চিন্তা করতে করতে আমাদের ব্রেইন একটা সারভাইভাল ব্রেইন হয়ে গিয়েছে যার প্রধান কাজ শুধু সারভাইভ করা বা টিকে থাকা। এই কারণে ব্রেইন যেটা চেষ্টা করে যেকোনো পরিস্থিতিতে কিভাবে সবচেয়ে কম শক্তি ক্ষয় করে বেঁচে চলে আসা যায়।
খুব সুন্দর একটা উদাহরণ দিয়েছেন মিলার এই বইতে, আপনাকে যদি একটা বড় অডিটোরিয়াম এ ছেড়ে দেয়া হয় যেখানে হাজার হাজার চেয়ার আছে, আপনার ব্রেইন কখনও চেয়ারের সেই সংখ্যা গুনতে যাবে না। আপনার যদি কোনো কাজ নাও থাকে তারপরও আপনার ব্রেইন সেটি করতে চাইবে না।
কিন্তু মজার ব্যাপার হলো, ঐ একই সময়ে আপনার ব্রেইন অডিটোরিয়ামের এক্সিট কোথায়, লিফট কোথায়, আগুন লাগলে ফায়ার এক্সিট কোথায় আপনার অবচেতন মন সাথে সাথে দেখে ফেলে। ব্যাপারটা এরপর থেকে খেয়াল করবেন। বিশাল অডিটোরিয়ামে যাওয়ার ১/২ মিনিটের মাথায় আপনার ব্রেইন নিজে থেকেই এই কাজগুলো করে ফেলবে, আপনি টেরও পাবেন না।
এই কাজগুলো আমাদের ব্রেইন সচেতনভাবে করে না; কিন্তু ব্রেইন এটা বুঝে যে যেকোনো পরিস্থিতিতে আমাদের সারভাইভ করতে পারতে হবে।
আপনাদের প্রশ্ন জাগতে পারে মার্কেটিং এর বইয়ে এই গল্প বলার কারণ কি? আচ্ছা মার্কেটিং কি জিনিস? মার্কেটিং হলো একটা পটেনশিয়াল কাস্টমারের কাছে কোনো কিছু বিক্রির চেষ্টা করা। আপনার একটা প্রোডাক্ট বা সার্ভিস আছে, আপনি সেটা একটা মানুষ যে কিনা পটেনশিয়াল কাস্টমার তাকে কনভিন্স করে তার কাছে বিক্রি করতে চান, এটাই সহজ কথায় মার্কেটিং।
তো বইয়ে সারভাইভাল গল্প বলার কারণ হলো, মিলার বোঝাতে চেয়েছেন যখনই আপনি একটা মার্কেটিং মেসেজ সাজাতে যাবেন, মেসেজ যত কমপ্লিকেটেড হবে আপনার পটেনশিয়াল কাস্টমারের বুঝতে তত শক্তি খরচ করতে হবে। যার ফলে তার সারভাইভাল ব্রেইন এই জটিল জিনিস উপেক্ষা করে অপেক্ষাকৃত কম শক্তি খরচ করতে হয় এমন মার্কেটিং মেসেজ গ্রহণ করে। অর্থাৎ কাস্টমারের কাছে যদি আপনার মার্কেটিং সহজ মনে হয়, তাহলে তার সারভাইভাল ব্রেইন আপনার প্রোডাক্ট বা সার্ভিস খুব সহজেই কিনবে।
এটার বাস্তব উদাহরণ মিলার দিয়েছেন স্টিভ জবসকে নিয়ে। আমরা সবাই জানি স্টিভ জবস কোনো তথ্য সরলীকরণে ব্যাপক জনপ্রিয় ছিলেন। স্টিভ জবস বলেছিলেন, আপনি যদি কোন ক্যামেরা বিক্রি করতে চান তাহলে ক্যামেরার Focus Length, ISO, Depth Range, Wide Angle এসব বিষয়বস্তু কাস্টমারকে ডিটেইলস এ না বুঝিয়ে যদি বলেন এই ক্যামেরা দিয়ে ছবি তুললে পেছনটা ব্লার হয়ে যায়, তাহলে কাস্টমার খুব সহজেই আপনার কথা বুঝতে পারবে।
জটিল জিনিস আরও জটিল করে না বুঝিয়ে সেটার সহজ, সরল উত্তর; যেটা ব্যবহারকারীর পক্ষে বোঝা সহজ, সেভাবে করতে পারলে প্রোডাক্ট বিক্রি করার হার অনেকগুণ বেড়ে যাবে।
স্টিভ জবসের এই কথা বলার সময় থেকে এখন পর্যন্ত আপনি যদি অ্যাপলের প্রোডাক্ট লঞ্চের কোনো ইভেন্ট দেখে থাকেন তাহলে দেখবেন, তারা কখনোই প্রোডাক্টের ফিচার নিয়ে জটিল কোনো ব্যাখ্যায় যান না। তাদের ব্যাখ্যাগুলো অনেকটা এরকম, “এই আইফোন আগেরটা থেকে দ্বিগুন ফাস্ট, এই ক্যামেরা আগের ক্যামেরা থেকে আটগুন দ্রুত ছবি তুলে।”
এরকম সহজতর ব্যাখ্যায় তারা প্রোডাক্ট জনসাধারণের জন্য মার্কেটে ছাড়ে। কেননা মিলারের মতে তারা এই মূলনীতিতে বিশ্বাসী, যেখানে ব্রেইনকে কম ক্যালরি খরচ করিয়ে নিজেদের মেসেজ পৌঁছানো সম্ভব।
আরেকটা বিষয় মিলার বলেছেন, যদিও ব্যাপারটা সরাসরি এই বিষয়ের সাথে রিলেটেড না কিন্তু তারপরও আপনাদের বলার লোভ সামলাতে পারছি না, বিজ্ঞানী ও দার্শনিক প্যাসকেল একবার একটা চিঠি লিখেন। লিখতে লিখতে চিঠির আকার বেশ বড় হয়ে যায়। লিখা শেষে প্যাসকেল লিখেন, “আমি খুব দুঃখিত! আমার চিঠিটা বেশ বড় হয়ে গিয়েছে। আমার হাতে যদি সময় থাকতো তাহলে আমি ছোট একটা চিঠি লিখতাম”
বিষয়টা যদি আপনি একটু চিন্তা করেন, প্যাসকেল বেশ গভীর একটা কথা বলেছেন। তিনি মূলত বোঝাতে চেয়েছেন, তাঁর হাতে যদি সময় থাকতো তাহলে এই বড় চিঠি থেকে অপ্রাসাঙ্গিক কথা বাদ দিয়ে ছোট্ট এবং গোছানো চিঠি লিখতেন। এই বিষয়টি কিন্তু আমার এই লেখার ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। এইযে আপনারা এতো কষ্ট করে এতক্ষণ ধরে পড়ছেন যদি আমি আরো সময় পেতাম তাহলে আরো ছোট করে সুন্দর করে গুছিয়ে লিখে আপনাদের ব্রেইনের ক্যালরি খরচ বাঁচিয়ে দিতাম।
এই উদাহরণ ব্যবহার করে মিলার বোঝাতে চেয়েছেন, আপনি যখন একটা কাস্টমারকে বোঝাতে যাবেন খুব Beat Around The Bush না করে সহজ ভাষায় আপনি ঠিক কি বিক্রি করছেন এবং কাস্টমারকে আপনার প্রোডাক্ট কেন ক্রয় করা দরকার, এতটুকুই বোঝাতে পারলেই কাজ শেষ।
তিনি বইয়ে এই বিষয়ে একটা কথা বলেছেন, “People Don’t Buy The Best Products; They Buy The Products They Can Understand The Fastest.” এর বাংলা অর্থ করলে দাঁড়ায়, কাস্টমাররা কখনই সবচেয়ে ভালো পণ্যটি কেনেনা, তারা সেই প্রোডাক্টই কিনে যেটা তারা দ্রুত বুঝতে পারে।
সব কথার শেষ কথা আপনি আপনার ম্যাসেজ যত সহজে কাউকে বোঝাতে পারবেন তত বেশিই আপনার লাভ। আর মানুষ গল্পের মাধ্যমে সহজে সবকিছু বুঝতে পারে। ঠিক তেমনই, আপনার কোম্পানি যত দ্রুত কাস্টমারকে বোঝাতে পারবে কেন তার আপনার কোম্পানীর পণ্য বা সেবা গ্রহণ করা উচিত, কিংবা সে আপনার পণ্য বা সেবা গ্রহণ না করলে তার কি ক্ষতি হবে, আপনার ততই বিক্রি বেড়ে যাবে।
মনে রাখবেন, কাস্টমার কখনো সেরা প্রোডাক্ট কিনে না। সে কিনে এমন প্রোডাক্ট যেটা সে ভালো বুঝতে পারে। কাস্টমারই আপনার গল্পের নায়ক হওয়া উচিত, আপনার ব্র্যান্ড নয়। এটাই হলো প্রতিটি অসাধারণ সফল ব্যবসার রহস্য৷
আজ এ পর্যন্তই। আগামী কোন লেখায় এই বই থেকে মার্কেটিং মেসেজ সাজানোর সাতটি স্টেপস নিয়ে আলোচনা করবো ইনশাআল্লাহ্। যারা মার্কেটিং মেসেজ সাজাতে ভুল করে থাকেন, তাদের জন্য বেশ ভালো কিছু থাকবে পরবর্তী লেখায়। আমাদের আজকের এই আলোচনাটি যদি আপনার ভালো লেগে থাকে তাহলে অবশ্যই একটি কমেন্ট করে জানাবেন এবং এবং আরও অনেকের উপকারের স্বার্থে শেয়ার করবেন।