প্রতিযোগিতামূলক শব্দটা ব্যবসায় তখনই আসে যখন আপনি এমন কোনো বিজনেস আইডিয়া নিয়ে কাজ করেন যা আপনার পাশাপাশি আরো অনেকেই করছে। তাই ব্যবসার ক্ষেত্রে আপনাকে এমন একটি ইন্ডিভিজ্যুয়ালিটি তৈরি করতে হবে যার মাধ্যমে আপনি হয়ে উঠবেন সবার চেয়ে আলাদা, থাকবেন সব ধরনের সমালোচনা ও টানাপোড়েনের উর্ধ্বে।
ধরেন, আপনি বেকার গ্র্যাজুয়েট। পড়াশোনা শেষ করে যে চিন্তা করছে আমি এখন একটা ব্যবসা শুরু করবো, উদ্যোক্তা হবো। এই সময়ে এসে উদ্যোক্তা সবাই হতে চায় তবে শেষ পর্যন্ত টিকে থাকতে পারাই আসল চ্যালেঞ্জ। এরকম একটা মুহূর্তে দাঁড়িয়ে আপনি খুঁজে বেড়াচ্ছেন কী নিয়ে কাজ করা যায়। ভাবতে ভাবতে আইডিয়া করতে পারলেন আপনার জামাকাপড় নিয়ে অনেক আগ্রহ, সুন্দর আর নতুনত্বে ভরা জামাকাপড় পরতে আপনার ভালো লাগে। সহজভাবে বললে ফ্যাশন জগত আপনার বড়সড় আগ্রহের জায়গা। আপনি চিন্তা করলেন আপনি নতুন করে এমন একটি জামাকাপড়ের ব্যবসা দাঁড় করাবেন যেখানে এই সময়ের সাথে তুলে ধরা যায় এমন সব কালেকশন থাকবে।
আপনি আপনার পরিকল্পনা অনুযায়ী শুরুও করলেন। এরপর দেখলেন আপনার মতো আরো একশোটা ব্যবসা প্রতিষ্ঠান বা ব্র্যান্ড অলরেডি মার্কেটে উপস্থিত। আপনি চিন্তা করলেন কীভাবে এদের টেক্কা দিয়ে এগিয়ে যাওয়া যায়। একটা সহজাত উপায় বেছে নিলেন। কিছু পার্সেন্ট ডিসকাউন্ট দেয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন, ছোট ছোট গিফটস পাঠানো শুরু করলেন। এরকম নানা ফ্যাসিটিলিজ দেয়া শুরু করলেন। এতে দেখা গেলো আপনার কাস্টমার আসা শুরু করলো অনেক তবে আশানুরূপ লাভ করতে পারলেন না। পাশাপাশি আপনার দেখাদেখি অন্যরাও এই পদ্ধতিগুলো অবলম্বন করা শুরু করল, যেখানে তাদের ব্যবসা অলরেডি প্রতিষ্ঠিত। সুতরাং, এই দৌড়ে তারা এগিয়ে গেলো আর আপনি পৌঁছে গেলেন লসের দুয়ারে।
রেড ওশান স্ট্র্যাটেজি
এই কাহিনীর এক পর্যায়ে এসে দেখা গেলো তারা আরো লাভবান হওয়া শুরু করে, আর আপনি সার্ভাইভ না করতে পেরে ব্যবসাই বন্ধ করে দিতে বাধ্য হন বা প্রচন্ড লসে থাকেন। আপনি যেভাবে অন্যের ব্যবসায়িক আইডিয়া দেখে নিজেও এই তুমুল কম্পিটিশনে ঝাপ দিলেন এটাকে বলে ‘রেড ওশান স্ট্র্যাটেজি’। যেখানে থাকে প্রচন্ড চ্যালেঞ্জ, যেখানে একজন ব্যবসায়ী আরেকজন ব্যবসায়ীকে প্রতিদ্বন্দ্বী মনে করে সারাক্ষণ অন্যকে টেক্কা দিতেই ব্যস্ত থাকে। এমনকি অন্যের ক্ষতি করতেও পিছপা হয় না।
এই ক্ষতিকর ও একইসাথে আক্রমণাত্মক ব্যবসার বিপরীতে যে স্ট্র্যাটেজি নিয়ে কাজ করা সম্ভব তার নাম ‘ব্লু ওশান স্ট্র্যাটেজি।’ The financial express এর মতে, বাংলাদেশে প্রায় ২ হাজার ই- কমার্স প্রতিষ্ঠান এবং ৫০ হাজার এফ-কমার্স প্রতিষ্ঠান রয়েছে। ফেসবুক বা সোশ্যাল প্ল্যাটফর্মগুলোর ব্যবসায়িক ফ্যাসিলিটির বদৌলতে গড়ে উঠেছে এই প্রতিষ্ঠানগুলো। যেখানে আবার নেই কোনো বাধা বা entry barrier ব্যবসায়ের ভাষায়। একইরকম প্রোডাক্টের ও বিশাল একটা ক্রেতা বা consumer শ্রেণি রয়েছে। যার কারণেই মূলত রেড ওশান পলিসির বেশি সুযোগ তৈরি হচ্ছে। এর মাঝেই যে ব্লু ওশান স্ট্র্যাটেজি দিয়ে তার বিজনেস এগিয়ে নিয়ে যেতে পারবে সেই এই কম্পিটিশনে নিজেকে আলাদা করে ফেলতে পারবে।
ব্লু ওশান স্ট্র্যাটেজি
একদম গতানুগতিক ধারা থেকে বের হয়ে ক্রিয়েটিভ, স্পেসিফিক ভাবে নিজেদের তুলে ধরার উপায় হলো ব্লু ওশান স্ট্র্যাটেজি। নিজেদেরকে আলাদাভাবে উপস্থাপন করে যেখানে কম্পিটিশনকে শুরুতেই হটিয়ে দেয়া। অর্থাৎ, ‘Creating demand, not competition’। বর্তমানের বাজারদরে আসলে ব্লু ওশান মার্কেট তৈরি করা খুবই কঠিন। কারণ ওপেন মার্কেটে সবার কাছে সবকিছুর এক্সেস আছে, সবাই চাইলেই অন্যেরটা দেখে আইডিয়া নিতে পারে। তবে একেবারেই অসম্ভব হবে তাও না। কিছু জিনিসের মাধ্যমে মোটামুটি লেভেলের একটা নিজস্বতা তৈরি করাই যায়। যেমন-
এলিমিনেট (Eliminate)
এমন এক ধরনের প্রোডাক্ট চেইন তৈরি করা, যেখানে এমন কোনো প্রোডাক্ট বা পণ্য সরাসরি না রাখা যেটি কি না অন্য ব্র্যান্ডের সাথে সরাসরি প্রতিযোগিতা তৈরি করে। অর্থাৎ, প্রতিযোগিতামূলক পণ্য বাদ দেয়ার সর্বোচ্চ চেষ্টা করা।
রিডিউস (Reduce)
এমন কোনো জিনিস আপনার প্রসেসিং এ রাখা যা অন্যের কাছেও আছে। রিডিউস ম্যাথডে কাজ করা।
রেইজ (raise)
এমন কোনো ফ্যাক্টর নতুন করে তৈরি করা যা সবার কাছে এই মুহুর্তে নেই, কিন্তু আপনি আপনার ব্যবসার জন্য নতুন করে সেটি রেইজ করলেন এবং নিজের ব্যবসায় প্রয়োগ করলেন।
ক্রিয়েট (create)
এমন কোনো সুযোগ যার মাধ্যমে নরমাল ইন্ডাস্ট্রির থেকে আপনি আপনার পণ্যের যেকোনো গুণাগুণ বাড়াতে পারবেন। এমন কিছু ক্রিয়েট করুন যেটা আর কেউ করছে না বা করা পর্যন্ত যেতে বহু দেরি। যেমন- কোনো মেশিনারি পার্টসের ব্যবহারের মাধ্যমে কাজকে সহজ করে প্রোডাকশন এর সময় কমিয়ে আনা। এমন বহুকিছু হতে পারে।
এছাড়াও ব্লু ওশান মার্কেটং এ কিছু ট্রিক্স কাজে লাগানো যেতে পারে যেগুলো যেকোনো ধরনের মার্কেটিং এই খুবই গুরুত্বপূর্ণ। যেমন-
১. কাস্টমারের প্রয়োজন বা নেসেসিটি রিড করতে পারা। যেকোনো প্রয়োজন অনুয়ায়ী সমাধান তৈরি করে সে পণ্য বাজারজাত করতে পারলে সহজেই ক্রেতাদের মনোযোগ পাওয়া যায়।
২. বিশ্বাসের জায়গা তৈরি করা যেটি কি না লং রানে কাস্টমারের সাথে এমন এক বন্ডিং তৈরি করে যার ফলে কাস্টমার চাইলেও নিজের আস্থাকে অন্য জায়গায় ডাইভার্ট করতে পারে না। এক ধরনের কমফোর্ট জোন তৈরি করে দেয়া।
৩. যেকোনো ধরনের পণ্যের সাথে ইমোশোনাল এটাচমেন্টের ভাবনাটাকেও গুরুত্বারোপ করা। অর্থাৎ, কোনো পণ্য কেনার সাথে ক্রেতার ইমোশনাল বন্ডিং এর জায়গা থেকে তার কাছে এটি কতটা গুরুত্বপূর্ণ হবে সে অনুযায়ী সে জিনিসটাকে কদর করবে এরকম চিন্তা করে কোনো প্রোডাক্ট নিয়ে আসা।
৪. প্রচার প্রসারকে একটা বড়সড় গুরুত্বের জায়গা থেকে দেখা। অনেক সময় অনেক জিনিস ভালো হলেও পজিটিভ প্রচারের অভাবে সেটি খুব একটা গুরুত্ব পায় না। তাই একটু আলাদাভাবে গতানুগতিক ধারা থেকে বেরিয়ে সেটিকে অন্যদের সামনে তুলে ধরাও একটি প্রয়োজনীয় ব্যাপার যেকোনো পণ্যের প্রায়োরিটি তৈরি করতে।
৫. কোয়ালিটির দিকে বিশেষভাবে নজর দেয়া। সময়ের সাথে সাথে কোয়ালিটি ডাউন হয়ে যায় এরকম পণ্য নিয়ে কাজ করলে আল্টিমেটলি অন্যদের সাথে পার্থক্য থাকে না।
তবে বাংলাদেশের মতো দেশের প্রেক্ষাপটে ব্লু ওশান মার্কেট তৈরি করা কঠিন। কারণ এখানে ওপেন মার্কেট পলিসির প্রভাব অনেক বেশি, সবাই সবার সবকিছুর এক্সেস খুব সহজেই পেয়ে যায় এবং কপি পেস্ট করতে দ্বিধা করে না। যার ফলে একটি পণ্য বের হওয়ার কিছুদিনের মধ্যেই তার নানাধরনের কপি প্রোডাক্টও বাজারে পাওয়া যায়।
ব্লু ওশান স্ট্র্যাটেজির উদাহরণ
আরএফএল গ্রুপের কথা এখানে আলোচনা করা যেতে পারে যারা খুব ভালো করে ব্লু ওশান মার্কেট তৈরি করতে পেরেছে। তাদের মাদার কোম্পানি প্রাণের কারণেই এটি করা সম্ভব হয়ে উঠেছিলো। যেমন ধরেন, ছোট থেকে আমরা ম্যাগিকেই নুডুলস হিসেবে জানি এবং অন্য যেকোনো নুডুলসকেও ম্যাগিই বলে ফেলি। প্রাণ তাদের মি: নুডুলস প্রোডাক্টটিকে এমনভাবে দাঁড় করালো যে বিদেশী ম্যাগির এই প্রভাব অনেকটাই দূর করে ফেললো। কীভাবে? আরএফএল যেহেতু প্রাণেরই প্লাস্টিক কোম্পানি তাই তারা মি: নুডুলস এর ফ্যামিলি প্যাকের সাথে নানা ধরনের প্লাস্টিকের জিনিস উপহার দেয়া শুরু করলো, যা করা ম্যাগির পক্ষে সম্ভব নয়। এদিকে তাদের যেহেতু এই বেইজ সাব কোম্পানি আছে প্রাণের জন্য বরং কম খরচে এরকম ছোটখাটো প্লাস্টিক পণ্য উপহার দেয়া খুব একটা জটিল কোনো সমস্যা নয়। এতে করে তারা কাস্টমার অ্যাটেনশন পাওয়া শুরু করলো। ফলে সহজেই ম্যাগির মার্কেট টেক্কা দিতে সক্ষম হয়ে নিজেরাই একটা স্বকীয়তা তৈরি করে ফেললো দেশীয় মার্কেটে।
সবসময় ব্লু ওশান কি সঠিকভাবে কাজে লাগে?
এর উল্টোটাও কিন্তু হতে পারে। যেমন ধরেন, আপনি আপনার জীবদ্দশায় সবসময় দেখে আসলেন টয়লেট ক্লিনার মানেই হারপিক বা নীল কালারের একটি বোতল। সে অনুযায়ী যারা কপি করলো তারাও নীল কালারেরই প্রোডাক্ট মার্কেটে বের করলো। আমাদের সাবকনশিয়াস মাইন্ড এভাবেই আমাদেরকে বোঝানো শুরু করলো যে টয়লেট ক্লিনার মানেই নীল কালারের একটা বোতল বা নীল কালারের জন্য একটা কমফোর্ট জোন রেডি। সেখানে যদি কেউ লাল কালারের বোতলের ক্লিনার নিয়ে আসে এবং অনেকগুলো নীলের মাঝে সেই লাল বোতলটা রেখে কাউকে নীলটা নিতে বলে আমাদের মাইন্ড কিন্তু সেটিকে রিজেক্ট করে সেই তথাকথিত কমফোর্ট জোন নীলের দিকেই ঝুঁকবে। তাই যখন ব্লু ওশান নিয়ে আমরা কাজ করবো অবশ্যই মাথায় রাখতে হবে সেটা কতটুকু যৌক্তিক ও প্রভাবিত করতে পারবে।
তবে সত্যিকার অর্থে ব্লু ওশান মার্কেট ধরে রাখা এই কম্পিটিটিভ সময়ে অনেক কঠিন। কারণ এখন ব্র্যান্ড warfare এর সময়। পৃথিবীতে প্রতিবছর প্রায় ৬ লাখ নতুন নতুন ভেঞ্চার তৈরি হচ্ছে। বিভিন্ন ধরনের জিনিস আবিষ্কার হচ্ছে, নতুন নতুন ধারা তৈরি হচ্ছে। তাই ব্লু ওশান বলতে তেমন কিছু টিকে নেই। তবে, অবশ্যই মানুষের চাহিদা ও চিন্তা ভাবনারও অনেক পরিবর্তন এসেছে। মানুষ আগের চেয়ে ক্রিয়েটিভ ইনপুটে বিশ্বাসী। সবকিছুতেই নতুনত্ব চায়। এই সুযোগকে কাজে লাগিয়েই নানা ধরনের ক্রিয়েটিভ জিনিসপত্র মার্কেটে নিয়ে আসা ও ভ্যালু দাঁড় করানো সম্ভব। তাই রেড ওশান এর মধ্য দিয়েই ব্লু ওশান তৈরি করা ও নানা জিনিস মার্কেটে নিয়ে আসা নিউ জেনারেশন চ্যালেঞ্জ।
‘So create and capture new demand and leave the competition behind’.