সুস্থ দেহ, সুন্দর মন — নিজেকে ভালো রাখার কয়েকটি টিপস

ভেবে বলুন তো, শেষ কবে একদম খোলা মনে প্রাণখুলে হাসতে পেরেছেন? বা সবকিছু ভুলে মাথা ঠান্ডা করে নিজের ভাবনাগুলো ভাবতে পেরেছেন? আমাদের গতিশীল জীবনে সারাদিন দৌড়ঝাপের মধ্যে মানসিক শান্তি ধরে রাখাও যেন কঠিন! বিভিন্ন ঝামেলার পিছনে দৌড়াতে দৌড়াতে নিজের খেয়াল রাখতেই আমরা ভুলে যাই। ফলে বিভিন্ন শারিরীক ও মানসিক সমস্যায় ভুগি। তবে, নিজের শরীর ও মনের উপর আসলে কিছুই নেই। ছোট ছোট কিছু নিয়মিত অভ্যাস করে আমরা সহজেই নিজের শরীর ও মনকে ভালো রাখতে পারি। প্রতিদিনের এই ছোট ছোট অভ্যাসগুলো আমাদের মন ভালো রাখবে, একই সাথে আমাদের শারীরিক সুস্থতা ও বাড়বে। 

নিজেকে যেভাবে ভালো রাখা যায় 

হালকা ব্যায়াম এর অভ্যাস গড়ে তুলুন

আমরা অনেকেই মনে করে থাকি, শুধুমাত্র ওজন কমানো বা শারীরিক শক্তি বাড়ানোর জন্যই মানুষ ব্যায়াম করে, কিন্তু ব্যাপারটা তা নয়। হালকা শারীরিক পরিশ্রম ও ব্যায়াম আমাদের মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য খুব গুরুত্বপূর্ণ। শারীরিক পরিশ্রমের সাথে আমাদের মস্তিষ্কের এন্ডরফিন নামের একটি হরমোনের সরাসরি যোগাযোগ রয়েছে। আমাদের মনের অতিরিক্ত চাপ কমানো, মানসিক অবসাদ কমানো, এবং মন ভালো করা অনুভূতি বাড়ানোতে ভূমিকা রাখে এই হরমোন। গবেষণায় দেখা গেছে যে, যারা নিয়মিত সামান্য পরিমাণে হলেও শারীরিক ব্যায়াম করেন তারা অন্যান্যদের থেকে তুলনামূলক কম বিষণ্ণতায় ভোগেন।

ব্যায়াম বলতে যে আপনাকে প্রতিনিয়ত জিমে যেতে হবে, বা ভারি ভারি ডাম্বেল নিয়ে ব্যায়াম করতে হবে ব্যাপারটা তেমন না। প্রতিদিন অন্তত ত্রিশ মিনিট থেকে এক ঘন্টা হাঁটা, নিজের ঘরেই কিছু ফ্রি হ্যান্ড এক্সারসাইজ করা, এমনকি যোগ ব্যায়ামেও আপনি বেশ ভালো ফলাফল পাবেন। এখানে মূল লক্ষ্য হচ্ছে আপনার শরীরকে একটিভ রাখা। নিয়মিত ব্যায়াম করলে শরীরের পেশিগুলোও কর্মক্ষম থাকে, ফলে অসুখ বিসুখ আপনাকে তেমন কাবু করতে পারবে না।

প্রয়োজন মনে হলেই বিশ্রাম নিন

কাজ ও বিশ্রাম আমাদের জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ। কিন্তু আমরা প্রায়ই অতিরিক্ত কাজের চাপে নিজেদেরকে বিশ্রাম দিই না। এটা আমাদের শরীর মন কোনোটার জন্যই ভালো নয়। একটানা কাজ করে গেলে আমাদের শরীরের উপর যেমন চাপ পড়ে, তেমনি আমাদের মস্তিষ্কও ক্লান্ত হয়ে যায়। এর ফলে আমরা স্বাভাবিক কর্মক্ষমতা হারিয়ে ফেলি, এবং ধীরে ধীরে আমাদের শরীর দুর্বল হয়ে পড়তে থাকে। একই সাথে অবসাদ বাসা বাঁধে মনেও। তাই যত গুরুত্বপূর্ণ কাজই হোক, অন্তত ৪৫ মিনিট কাজ করার পর ১০-১৫ মিনিট বিরতি নেওয়া উচিত। 

আপনি একটি টাইমার বা এলার্ম সেট করে রাখতে পারেন, নির্দিষ্ট সময় কাজ করার পর এলার্ম বাজলে বিরতিতে যাওয়া, আবার বিরতি শেষে এলার্ম বাজলে কাজে ফেরত আসা। একে বলা হয় পমোডরো টেকনিক। এটি কাজে ফোকাস রাখা, একই সাথে প্রয়োজনের সময় বিরতি নেওয়ার ক্ষেত্রে দারুণ কাজ করে। বিরতির সময়টাতে নিজের পছন্দের কিছু করতে পারেন, যেমন গান শোনা, পছন্দের কোনো মিউজিক শোনা, একটু চা খাওয়া, অথবা শুধু চোখ বন্ধ করে শুয়েই থাকা। এগুলো আপনার মস্তিষ্ককে কিছুক্ষণের জন্য স্বস্তি দেবে এবং আপনি আরো ভালো মুডে কাজে ফেরত যেতে পারবেন। 

মাঝে মাঝে ঘুরতে যাওয়া খারাপ বা অপচয় নয়

আমরা প্রায়ই নিজেদের বিভিন্ন চাহিদাকে এড়িয়ে যাই খরচ বেশি হবে, অথবা সময় নষ্ট এসব ভেবে। কিন্তু শরীর ও মনের ভালো থাকার জন্য পরিচিত পরিবেশ থেকে বের হয়ে একটু ভিন্ন পরিবেশে কিছুদিন থেকে আসা একদমই অপচয় নয়। আমাদের প্রতিদিনকার একদিনের রুটিন থেকে বের হয়ে দুটো দিন যদি প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের মাঝে শান্তিতে কাটিয়ে আসা যায়, তাহলে মন মানসিকতা অনেকটাই পাল্টে যায়, কাজের চাপের ক্লান্তি দূর হয়, এবং মস্তিষ্ক বিশ্রাম পায়। 

এ কথা গবেষকদের দ্বারা পরীক্ষিত যে, প্রকৃতির সান্নিধ্য আমাদের মস্তিষ্কে ডোপামিন ও সেরোটোনিন এর নিঃসরণ ঘটায়। এই দুইটি হরমোনকে ফিল গুড হরমোন বলা হয়ে থাকে, যেগুলো মনের প্রশান্তি বাড়ায়, এবং হতাশার মতো নেতিবাচক অনুভূতিগুলোকে কমিয়ে দেয়। এছাড়াও নতুন জায়গায় ঘুরে দেখতে যেটুকু হাঁটাহাঁটি হয় তা আমাদের শরীরকে সক্রিয় রাখে। ভিন্ন ভিন্ন এলাকায় ঘুরতে গিয়ে নতুন নতুন অভিজ্ঞতা হয়। ভালো সময়ের স্মৃতি তৈরি হয়, যা আমাদের চিন্তাশক্তি ও সৃজনশীলতাকে নতুন মাত্রা দেয়।  তাই সুস্থ শরীর ও মনের জন্য মাঝে মাঝে কোথাও ঘুরে আসা বা ট্যুর দেয়া যেতেই পারে!

আয়োজন করে যেতে পারেন অপরিচিত এলাকায়, অথবা পরিচিত কোনো আত্মীয়স্বজনের কাছেই কাটিয়ে আসতে পারেন কয়েকটা দিন, এতে করে সম্পর্কও ভালো হবে। মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে পরিবেশ পরিবর্তন, আর আপনার প্রতিদিনের কাজের রুটিন থেকে বেরিয়ে এসে নিজেকে একটু আরাম দেয়া।

টাইম ম্যানেজমেন্ট ইজ দ্যা কী

আমরা জানি আমাদের প্রতিদিন অনেক কাজই থাকে, কিন্তু ঠিকমতো টাইম মেইনটেইন করা হয় না বলে অনেক কাজ জমে কাজের পাহাড় হয়ে যায় একেবারে। অনেক কাজ একসাথে জমে গেলে সেগুলো যেমন একবারে শেষ করাও কঠিন, আবার বেশি কাজ একসাথে করতে গেলে মনে বিরক্তিও চলে আসে। তাই কাজ জমিয়ে না রেখে প্রতিদিনের কাজ প্রতিদিন শেষ করে ফেলাই ভালো অভ্যাস। 

এক্ষেত্রে কাজ অনুযায়ী টাইম ম্যানেজমেন্ট হতে পারে আপনার বন্ধু। 

টাইম ম্যানেজমেন্ট ভালোভাবে করার জন্য আপনি একটি টু ডু লিস্ট করে রাখতে পারেন। অথবা প্রতিদিনের জন্য নির্দিষ্ট রুটিন সেট করে রাখতে পারেন। রুটিন অনুযায়ী কাজ করলে সময় নষ্ট হবার সম্ভাবনা কম, যার ফলে প্রতিদিনকার কাজ সেই দিনই শেষ হয়ে যাবে। রুটিনে কাজের পাশাপাশি বিশ্রাম অথবা নিজের জন্য ফ্রি টাইম রাখতেও ভুলবেন না। না হয় টানা কাজে শরীর মন যদি ক্লান্তই হয়ে যায়, তাহলে বিশেষ কোনো লাভ হবে না। 

নিজের শখকে ভুলে যাবেন না

আমাদের সবারই ছোট-বড় টুকটাক অনেক শখ থাকে, যে কাজগুলো আমরা মন ভালো থাকার জন্য করি, এগুলো করলে আমাদের ভালো লাগে। কিন্তু অনেক সময় এই কাজের চাপে আমাদের শখগুলো মরে যায়। ফলে বোরিং কাজ করতে করতে আমাদের মধ্যে ক্লান্তি ও বিরক্তি চলে আসে। শখের কাজগুলো আমাদের সৃজনশীলতা বাড়ায়, মানসিক চাপ কমায়, মন শান্ত ও ফুরফুরে রাখে, এবং বিভিন্ন এক্সট্রা কাজে দক্ষতা বাড়িয়ে তোলে।

 ছবি আঁকা, বাগান করা, পছন্দমত জিনিস বানানো, গান শোনা ইত্যাদি আমাদের মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য অত্যন্ত উপকারী। দিনে কয়েক ঘন্টা, অথবা সপ্তাহে নির্দিষ্ট একটা দিন রাখতে পারেন নিজের পছন্দের কাজের জন্য। 

পরিমাণ মতো পানি পান করুন

আমরা প্রায়ই শুনি যে ডাক্তার রোগীদের উপদেশ দিচ্ছেন প্রতিদিন অন্তত আট গ্লাস পানি পান করতে। আমাদের শরীরের একটা বড় অংশই হচ্ছে পানি। পানির অভাবে আমাদের শরীর হোক বা মস্তিষ্ক, কোনোটাই ঠিক মত কাজ করতে পারে না। পানির অভাবে আমাদের ডিহাইড্রেশন হয়, ফলে দেখা দিতে পারে ত্বক ও চুলের সমস্যা, দুর্বলতা ও ক্লান্তি। এছাড়াও, আমাদের শরীরের তাপমাত্রা ঠিক রাখা, খাবার হজম প্রক্রিয়ায় সাহায্য করা, শরীর থেকে বিষাক্ত পদার্থ বের করে দেওয়া এগুলোর জন্যও পানি পান করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তাই প্রতিদিন অন্তত আট গ্লাস পানি খাওয়ার চেষ্টা করতে হবে। 

পর্যাপ্ত পরিমাণে ঘুমান 

আমাদের শারীরিক ও মানসিক শান্তির জন্য ঘুমের গুরুত্ব অপরিহার্য। বিজ্ঞান বলে, একজন পূর্ণবয়স্ক মানুষের সুস্থতার জন্য প্রতিদিন কমপক্ষে ছয় থেকে আট ঘণ্টার টানা ঘুম জরুরী, এবং সেটা অবশ্যই গভীর ঘুম হতে হবে। ঘুমের মধ্যে বাঁধা এলে, বা একটু পর পর ঘুম ভাঙলে সেটাকে পরিপূর্ণ ঘুম বলা যায় না। 

দৈনিক আট ঘন্টা পরিপূর্ণ ঘুমের জন্য আমরা কিছু অভ্যাস করে দেখতে পারি। যেমন, দুপুরের পরে চা কফি বা অন্য কোনো ক্যাফেইন যুক্ত খাবার বা পানীয় না খাওয়া, বেডরুমকে শোয়ার জন্যই তৈরি রাখা, রাতে খুব ভারি কোনো খাবার না খাওয়া, রাত দশটার মধ্যেই শোয়ার জন্য মানসিকভাবে প্রস্তুত থাকা, বেডরুমে বা খাটের উপরে খাওয়াদাওয়া, অন্য কোনো কাজ না করা এসব অভ্যাস আমাদের শান্তির ঘুম আসতে সাহায্য করে।

অতিরিক্ত চিন্তাভাবনা ও মানসিক অশান্তিও ঘুমের বেশ ব্যাঘাত ঘটায়। ঘুমানোর আগে ভারী বা সমস্যার কিছু নিয়ে না ভাবাই ভালো। হালকা গরম পানিতে শাওয়ার নিলে সেটাও ভালো ঘুমে সাহায্য করে। এছাড়াও ল্যাভেন্ডার জাতীয় হালকা সুবাস, বা শোয়ার আগে কিছুক্ষণ মেডিটেশন, এসবও ঘুম ভালো করতে সহায়ক। 

সেলফ কেয়ার এর অভ্যাস করুন 

নিজের দিকে খেয়াল রাখা খুব জরুরি। রোজকার কাজের চাপে আমরা প্রায়ই নিজেদের দিকে খেয়াল করতে ভুলে যাই। কিন্তু অন্যান্য সবকিছুর মতো আপনার নিজেরও দরকার যত্ন। ছোট ছোট হেলদি অভ্যাস করে নিজেকে রাখতে পারেন সুস্থ এবং সবসময়ের জন্য তৈরি। 

যদি কখনো রান্নাবান্নার সময় না থাকে, বা কাজের চাপে প্রচন্ড ক্লান্ত হয়ে যান, তাহলে বাইরে থেকে খাবার আনানো একদমই খারাপ কিছু নয়। বিছানায় মাথার কাছে টেবিলে রাখতে পারেন পানি, সকালে ঘুম থেকে উঠেই এক গ্লাস পানি খেলে আপনি যেমন হাইড্রেটেড থাকবেন, লম্বা সময়ে স্বাস্থ্যের জন্যও এটা ভালো। সপ্তাহে একদিন এড়িয়ে চলতে পারেন সবরকম তৈলাক্ত খাবার। রাতে ঘুমাতে যাওয়ার আগে ১০-১৫ মিনিট সময় দিতে পারেন স্কিনকেয়ারে। এরকম ছোট ছোট হেলদি কিছু সেলফ কেয়ার অভ্যাস আপনাকে স্বস্তি দেবে, এবং এগিয়ে রাখবে পরবর্তী সময়ের জন্য। 

থিংক পজিটিভ, ফিল পজিটিভ

আমাদের জীবনে দুঃখ, হতাশা, ঝড় ঝাপটা থাকেই। সেগুলো চলে গিয়ে আবার ভালো সময়ও ফেরত আসে। এই খারাপ সময়টাকে টিকে থাকার জন্য আমরা যেটা করতে পারি সেটা হচ্ছে পজিটিভ থিংকিং। যার মানে, নিজের ভালো সময়গুলোর কথা চিন্তা করা, বা ভবিষ্যতে কীভাবে আরো উন্নতি করা যায় সেইসব ভাবা। 

নেগেটিভ থিংকিং বা নেতিবাচক চিন্তাধারা থেকে মনে হতাশা, দুশ্চিন্তা, ও অস্থিরতা আসে। এগুলো আমাদের মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য খুবই ক্ষতিকর, একই সাথে শরীরের ওপরেও এর বাজে প্রভাব পড়ে। নেগেটিভ চিন্তাভাবনা সরাসরি আমাদের ঘুমের উপরে প্রভাব ফেলে, তাই আমাদের যতদূর সম্ভব এড়িয়ে চলতে হবে। হ্যাঁ, হয়তো সব সময় পরিস্থিতি আমাদের অনুকূলে থাকবে না, তারপরেও জীবনের পজিটিভ দিকগুলোতে যতটা সম্ভব ফোকাস করা ভালো। 

এজন্য আপনি প্রতিদিন অনুপ্রেরণামূলক কিছু পড়তে শুনতে পারেন। ভালো কোনো বইয়ের একটা চ্যাপ্টার অথবা অডিও বুক, বিভিন্ন সেলফ হেল্প ধরনের বই, নন ফিকশন ইত্যাদি পড়তে পারেন। জীবনের কী কী পেয়ে আপনি কৃতজ্ঞ সেসব জিনিস সম্পর্কে ভাবতে পারেন, অথবা ডায়েরিতে লিখে রাখতে পারেন। নিজের ভবিষ্যৎ লক্ষ্য সম্পর্কে প্ল্যানিং করতে পারেন, কোন পথে এবং কীভাবে সেই লক্ষ্য অর্জন করবেন, তার জন্য কী কী করা জরুরী এসব নিয়ে ভাবতে পারেন। পজেটিভ থিংকিং আমাদের মন ভালো রাখে এবং নিজের লক্ষ্যের দিকে বেশ খানিকটা এগিয়ে দেয়। 

পরিবার ও প্রিয় মানুষদের সময় দিন

এ কথা অস্বীকার করার উপায় নেই, যে দিন দিন আমাদের উপর কাজের চাপ বাড়ছেই। এই চাপে কাছের মানুষও মাঝে মাঝে দূরে চলে যাচ্ছে। হয়তো মাঝে মাঝে পরিবারের সদস্যদের সাথেও ঠিকমতো দেখা অথবা কথাই হয় না।টেকনোলজির যুগে হয়তো সবকিছু হাতের মুঠোয় চলে এসেছে। একটা ক্লিক, ম্যাসেজ অথবা ভিডিও কলের মাধ্যমেই আমরা যোগাযোগ করতে পারি অনেক দূরে থাকা মানুষের সাথে। কিন্তু তাতে কি আর সেই মুখোমুখি বসে আড্ডার স্বাদ পাওয়া যায়? পরিবারের মানুষজন ও পছন্দের মানুষদের সময় দেওয়াও নিজেকে ভালো রাখা এবং মন ভালো রাখার একটি উপায়। সারাদিনের চিন্তা ও মন খারাপ দূর হয়ে যেতে পারে কাছের মানুষদের সাথে কিছুটা ভালো সময় কাটালে, তা হোক ডিজিটাল মাধ্যমে অথবা সামনাসামনি।

হুট করে দেখা করা, ছোটখাটো কিছু উপহার দেওয়া, তাদের জন্য কিছু করা বা এমনি কল করে গল্প করার মাধ্যমেও আমরা যেমন তাদের খোঁজ খবর নিতে পারি, এই সাথে নিজের ভালো থাকার জন্যও কিছু করতে পারি। অন্তত বিকেলের নাস্তা বা রাতের খাবারটা পরিবারের সবার সাথে খাওয়া, ছুটির দিনে সবাই মিলে স্পেশাল কিছু করা, ঘুরতে যাওয়া, বাসায় ছোটখাটো অনুষ্ঠানে এরেঞ্জ করা বা আত্মীয় স্বজনদের দাওয়াত দেয়া, এইসব ছোট বড় ভালো অভিজ্ঞতা গুলোই আমাদের মনে থাকে, এবং স্মৃতি তৈরি হয়। খারাপ সময়ে এই স্মৃতিগুলোই আমাদেরকে ভরসা দেয় এবং এগিয়ে যাওয়ার সঙ্গী হয়। তাই নিজেকে ভালো রাখতে প্রিয় মানুষদের কাছাকাছি থাকাও জরুরী। 

অপচয় কম, সঞ্চয় বেশি

বর্তমানে বড় স্কেলের মার্কেট এবং অনেক অনেক জিনিসের ভিড়ে চোখে তাক লেগে যাওয়াই স্বাভাবিক। মার্কেটে এখন প্রত্যেকটা জিনিসের অনেকগুলো করে অপশন থাকে। এত অপশনের ভিড়ে আমরাও খেই হারিয়ে ফেলি, যে কোন জিনিসটা আমাদের আসলেই প্রয়োজন, আর কোন জিনিসটা আমরা চোখে দেখে ভালো লাগায় কিনে নিচ্ছি। এর ফলে প্রায়ই আমরা প্রয়োজনের অতিরিক্ত খরচ করে ফেলি, যেটা অপচয় হিসেবে ধরা হয়।

প্রয়োজনীয় অতিরিক্ত জিনিসটা কেনার পরে সাময়িক ভালো লাগলেও, দুদিন পরে ব্যবহার না হওয়ার কারণে সেটা হয়তো পড়ে থাকে, অথবা চোখের আড়ালে পড়ে নষ্ট হয়ে যায়। এছাড়া প্রয়োজনের অতিরিক্ত জিনিসও অযথা জায়গা নেয়, ঘর এলোমেলো হয়ে থাকে, এবং সেখানে থাকতে কারোরই ভালো লাগে না। 

এছাড়াও ভবিষ্যতে অনেক কিছুই ঘটতে পারে, সে কথা ভেবে সঞ্চয় করা জরুরী। হঠাৎ করে যাতে কোনো বিপদে না পড়তে হয়, অথবা কোনো একটা প্রয়োজনে যদি হুট করে দরকার হয়, সঠিক সময়ে একটা সুযোগ যাতে হাতছাড়া না হয়, এজন্য সঞ্চয় করা জরুরী। তবে এমন নয় যে হুট করে আপাতত যা লাগছে না তার সবই ফেলে দিতে হবে, অথবা শুধুমাত্র নির্দিষ্ট কিছু জিনিস নিয়েই চলতে হবে। এটাকে আপনি ধাপে ধাপে করতে পারেন। যেমন- প্রয়োজনের অতিরিক্ত জিনিস ডিক্লাটার করা, খুব দামি কোনো রেস্টুরেন্টে না গিয়ে ছোটখাটো ক্যাফেতে যাওয়া, অথবা হোমমেড খাবার দিয়েই পিকনিক করা, প্রতিদিন অন্তত নির্দিষ্ট একটা এমাউন্টের টাকা বাঁচানোর চেষ্টা করা এসব ছোটখাটো পদক্ষেপই আমাদেরকে বড় সঞ্চয়ে সাহায্য করবে। 

হুটহাট কোনো কিছু কিনে ফেলাকে ইমপালস বায়িং বলা হয়। এটা ঠেকাতে মনোবিজ্ঞানীরা একটা ছোট পরামর্শ দেন, সেটা হচ্ছে চব্বিশ ঘন্টা রুল। চব্বিশ ঘন্টা রুল হচ্ছে, আপনার যদি কিছু একটা পছন্দ হয়, কিন্তু আপাতদৃষ্টিতে এটার প্রয়োজন না থাকে, তাহলে অন্তত চব্বিশ ঘন্টা অপেক্ষা করুন। ২৪ ঘন্টা পর যদি আপনার মনে হয় এটা আসলেই পছন্দ, সে ক্ষেত্রে আপনি কেনার সিদ্ধান্ত নিতে পারেন। অথবা অন্তত এক ঘুম দিয়ে উঠে তারপর সিদ্ধান্ত নিতে পারেন। এতে হুটহাট ইমপালস বায়িং এর সম্ভাবনা অনেক কমে যায়, এবং ঝোঁকে পড়ে কোনো কিছু কিনে পরে আফসোস করতে হয় না। 

ডিজিটাল ডিটক্স : কিছুটা সময় প্রযুক্তির বাইরে

বর্তমানে আমরা ইন্টারনেট, সোশ্যাল মিডিয়া এবং বিভিন্ন ডিভাইসের উপর প্রায় সম্পূর্ণভাবে নির্ভরশীল হয়ে পড়েছি। আমাদের পড়াশোনা, কাজকর্ম, এমনকি অবসর বিনোদনেও জড়িয়ে রয়েছে ডিজিটালাইজেশন। বিভিন্ন ডিজিটাল মিডিয়া এবং ডিভাইস ছাড়া এখন প্রায় কোনো কাজকর্মই সম্ভব নয়। তবে অতিরিক্ত ব্যবহারের ফলে আমাদের মানসিক ও শারীরিক স্বাস্থ্যের উপরে খারাপ প্রভাব ফেলছে ডিজিটালাইজেশন। বিশেষ করে মস্তিষ্ক ও চোখের উপর এর খারাপ প্রভাব লক্ষণীয়। এছাড়াও এর ফলে মানসিক অবসাদ, একাকীত্ব এবং স্ট্রেস বেড়ে যায়। মাথা ব্যথা, ঘাড় ব্যথা, ঘুমাতে সমস্যা ইত্যাদি অনেক ধরনের অসুস্থতা দেখা দেয়।

কিছু সময়ের জন্য ডিজিটাল ডিভাইস এবং ইন্টারনেট থেকে দূরে থাকাটা আমাদের জন্য হতে পারে শান্তির। নির্দিষ্ট কিছুটা সময় সকল রকমের ডিজিটাল মাধ্যম থেকে দূরে থাকাই হচ্ছে ডিজিটাল ডিটক্স। এর ফলে আমাদের শরীর ও মন যান্ত্রিকতা থেকে কিছুটা বিশ্রাম পায়, এবং পরবর্তী ধাক্কা নেয়ার জন্য কিছুটা সময় পায়। মস্তিষ্কে চাপ কমে, এবং আমরা নিজেদের মতো চিন্তা করার সুযোগ পাই।

ডিজিটাল ডিটক্সিফিকেশন আমরা ছোট ছোট পদক্ষেপে শুরু করতে পারি। প্রথমেই একদম মোবাইল ইন্টারনেট সব বন্ধ করে দিয়ে কোথাও চলে যাওয়াটা কাজের কাজ হবে না। তার বদলে দিনের ছোট একটা সময় দিয়ে আমরা শুরু করতে পারি, যেমন প্রতিদিন নির্দিষ্ট এক ঘন্টা কোনোরকম মোবাইল, টিভি অথবা ইন্টারনেট ব্যবহার না করে কাটাতে পারি। বই পড়া, বাগান করা, বা শখের কোনো কাজ আমরা এই সময়টাই করতে পারি। বা এই সময়টা পরিবারের সবাই একসাথে বসে আড্ডা দিয়েও কাটাতে পারি। 

আমাদের কাজে মনোযোগ নষ্ট হওয়ার আরেকটা কারণ হচ্ছে মোবাইলের নোটিফিকেশন। আমরা মনোযোগ দিয়ে কিছু করছি, কিন্তু ফোনে অপ্রয়োজনীয় নোটিফিকেশন এসে আমাদের সেই মনোযোগ ভেঙ্গে যায়। অন্তত মোবাইল থেকে নোটিফিকেশন বন্ধ করে রাখলে এই ফোকাস আমরা ধরে রাখতে পারি। 

ডিজিটাল ডিটক্সের আরেকটা উপায় হচ্ছে আপনার স্ক্রিন টাইম সীমিত করে ফেলা। প্রতিদিন একটা নির্দিষ্ট সময় নির্ধারণ করুন প্রয়োজন ছাড়া ফোন বা কম্পিউটার ব্যবহারে। সেই সময়টা খুব বেশি হবে না, এবং চেষ্টা করবেন সেটা মেনে চলার। এটা আমাদের চোখ, স্বাস্থ্য এবং মনোযোগ ধরে রাখার জন্য খুবই উপকারী। 

নিজেকে ভালোবাসুন

বলা হয়ে থাকে, আমরা নিজেরাই নিজেদের সবচেয়ে বড় সমালোচক। কথাটা মিথ্যা নয়, অনেক ক্ষেত্রেই আমরা নিজেদেরকে অন্যের সাথে বড় বেশি তুলনা করি, আত্মমূল্যায়ন করি না, বা নিজেকে ছোট মনে করি, যা হতাশা ও মানসিক চাপের জন্ম দেয়। কিন্তু মন ভালো রাখতে আত্মবিশ্বাস এবং ভরসা রাখা খুবই জরুরী। আপনি নিজে যখন নিজের উপর ভরসা করতে পারবেন, তখনই আপনি সব রকমের বাধা-বিপত্তি পার হতে পারবেন।

নিজেকে ভালোবাসার একটা গুরুত্বপূর্ণ ধাপ হল নিজেকে মেনে নেয়া। কোনো মানুষই স্বয়ংসম্পূর্ণ নয়, আমাদের প্রত্যেকেরই কিছু ইতিবাচক ও নেতিবাচক দিক আছে। এছাড়াও, সবাই সব কাজে সেরা হতে পারে না। একেকজনের শক্তি ও দুর্বলতা একেক রকম হয়ে থাকে। আমাদের কাজ হচ্ছে নিজের শক্তির জায়গাটা খুঁজে বের করে সেটাকে ঠিকমত ব্যবহার করতে পারা, আর নিজের দুর্বল দিকগুলো নিয়ে হতাশ না হয়ে সেগুলো মেনে নেয়া, এবং সম্ভব হলে কাটানোর চেষ্টা করা। নিজেকে নিয়ে আগেই হতাশ হয়ে গেলে সামনে এগিয়ে যাওয়া কঠিন, তাই সবকিছুর আগে নিজেকে নিজে ভরসা করতে হবে। ভুল সবারই হয়, মানুষ ভুল করতে করতেই শেখে, তাই, নিজের ছোটখাটো ভুলে নিজেকে খুব বেশি দোষারোপ করবেন না। বরং সেই ভুল থেকে শিক্ষা নিয়ে আমাদের এগিয়ে যেতে হবে।

নিজেকে অন্যের সাথে তুলনা করা অযথা মানসিক চাপের আরো একটি কারণ। মনে রাখতে হবে প্রত্যেকটা মানুষের জীবন, অভিজ্ঞতা, পরিস্থিতি ভিন্ন ভিন্ন হয়ে থাকে, একজনের সাথে আরেকজনের কোনো মিলই থাকেনা। তাই নিজেকে অন্যের সাথে তুলনা না করে নিজস্ব লক্ষ্য ঠিক করা এবং তার দিকে এগিয়ে যাওয়াই সফলতার দিকে আপনাকে নিয়ে যাবে। 

সবশেষে বলা যায়, আমাদের সুস্থ শরীর ও মনের সাথে সুখী জীবন যাপনের বেশ গভীর সম্পর্ক রয়েছে। শরীর ও মন ভালো না থাকলে খুব স্বাভাবিকভাবেই জীবনে আনন্দ থাকে না। কিন্তু বর্তমানের গতিময় জীবনের সাথে মানিয়ে নিতে নিতে শরীর ও মনের সুস্থতা পেছনে পড়ে যায়। এইসব ছোট খাটো ভালো অভ্যাসগুলো নিজেদের রুটিনের মধ্যে নিয়ে নিতে পারলে হয়তো দুই এক দিনেই পরিস্থিতি বদলে যাবে না, অথবা এত দিনের চাপ এই কয়েকদিনেই কমে যাবে না। তবে কোথাও একটা আমরা শুরু করতে পারি, আর সেই শুরু করাটা হোক এই ছোট ছোট অভ্যাসগুলো দিয়েই।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *