রান্নার অনুষ্ঠান হিসেবে আমাদের অনেকেরই পছন্দ মাস্টারশেফ আমেরিকা। আর সেখানে সাদা চুলের রাগী একজন শেফকে চেঁচামেচি করতে আমরা প্রায়ই দেখি। খাবারের স্বাদে একটু ভুল হোক, বা ডেকোরেশনে অবহেলা, তার চড়া মেজাজের ঝাঁজ টিভির পর্দা ভেদ করে দর্শকদের কাছেও পৌছে যায়! আমরা প্রায় সবাই তাকে চিনি, এই মাথা গরম শেফ এর নাম গর্ডন র্যামসে! রান্নার জগতে শেফ হিসেবে তাকে একনামে সবাই চেনে। সারা বিশ্বে বর্তমানে তার পঞ্চাশেরও বেশি রেস্টুরেন্ট চালু রয়েছে, এবং সেরা রেস্টুরেন্টের খেতাব হিসেবে মিচেলিন স্টার রয়েছে ১৭টি! তবে এটাই কি তার একমাত্র পরিচয়? শুধুমাত্র এই ঝাঁঝালো রাগ ছাড়াও আরো অনেক ফ্লেভারেই গর্ডন র্যামসের পরিচয়, যা তাকে আলাদা বিশেষত্ব দিয়েছে।
কেমন ছিল গর্ডন র্যামসের ছেলেবেলা?
১৯৬৬ সালের ৮ই নভেম্বর গর্ডন জেমস র্যামসে স্কটল্যান্ডের ছোট জনস্টনে জন্মগ্রহণ করেন। বাবা গর্ডন র্যামসে সিনিয়র এবং মা হেলেন র্যামসের ঘরে তিনি ছিলেন দ্বিতীয় সন্তান। গর্ডনের ছোটবেলা কাটে শেকসপীয়ারের শহর, ইংল্যান্ডের বিখ্যাত স্ট্র্যাটফোর্ড অন অ্যাভন এ। র্যামসের ছোটবেলা থেকেই তার পরবর্তী জীবনে অনেক প্রভাব পড়ে এবং এটা অনেকটাই তাকে গড়ে তুলতে সাহায্য করেছে। এবং নিজের মতো করে একটা পরিচয় তৈরি করতে এবং নিজের মতো করে নিজের একটা পরিচয় তৈরি করতে তবে র্যামসের ছোটবেলা অন্য আর দশটা বাচ্চার মত আনন্দময় ছিল না। তার বাবা র্যামসে সিনিয়র ছিলেন অ্যালকোহলে আসক্ত, এবং তার আচার-আচরণে এর বেশ ভালো প্রভাবই দেখা যেত। তিনি বেশিদিন কোনো চাকরিতে স্থায়ী থাকতে পারতেন না, যার ফলাফল হিসেবে র্যামসেকেও ছোটবেলায় বেশ কয়েকবার শিফট করতে হয়েছে। আর্থিক দুরবস্থাও নিত্য সঙ্গী ছিল। র্যামসের মা হেলেন ছিলেন একজন নার্স, যিনি কঠোর পরিশ্রম করে গেছেন পরিবারের জন্য, যাকে দেখে র্যামসে কিছুটা হলেও শক্তি পেতেন।
অ্যালকোহলে আসক্ত হওয়ার কারণে র্যামসে সিনিয়রের মেজাজ থাকতো বেশ চড়া, প্রায় পরিবারের সদস্যদের উপর চড়াও হতেন, বেশ অত্যাচার সইতে হয়েছে হেলেন, এমনকি ছোট র্যামসে ও তার ভাইবোনদেরও। র্যামসের নিজের ভাষায়, “বেড়ে ওঠার সময় আমার সামনে কোনো আদর্শ ছিলো না। যাই আমি দেখেছি, অ্যালকোহলে আসক্ত বাবা থেকেই দেখেছি। কাজেই আমি বুঝতে পেরেছিলাম আমাকে এর বিপরীত হতে হবে। এবং সেখান থেকেই এই খারাপ পরিবেশ থেকে বের হয়ে যাওয়ার চিন্তা মাথায় আসে।”
সংসারের এইরকম পরিবেশ থাকা সত্ত্বেও র্যামসে সাহস ও ধৈর্য ধরতে শিখেছিলেন মা হেলেনকে দেখে। কঠোর পরিশ্রমী মা সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছেন সন্তানদের ভালোবাসার, তাদের জন্য কিছু করার। র্যামসে বলেন, তিনি তার মাকে ছুটির দিনেও লম্বা সময় ধরে টানা কাজ করতে দেখেছেন, যাতে তার সন্তানদের জীবন একটু সুন্দর, একটু সুখের হয়। যে কারণে খাবার টেবিলে যা ই পরিবেশন করা হতো, র্যামসে সেটিকে সম্মানের চোখে দেখতেন। মায়ের প্রতি তার ছিল বিশ্বাস, সম্মান ও ভালোবাসা। ধারণা করা যায় এখান থেকেই র্যামসে তার কঠোর পরিশ্রম এবং ধৈর্য এবং লক্ষ্যে অবিচল থাকার শিক্ষা পেয়েছেন।
রান্নার প্রতি ভালোবাসা যেভাবে জন্ম নেয়
রান্নার প্রতি গর্ডন র্যামসের ভালোবাসা কিন্তু ছোটবেলা থেকে নয়। বরং জীবনের বেশ কিছুটা সময় বরং তিনি রান্নাঘর থেকে দূরেই ছিলেন। ছোটবেলায় এবং টিনএজ এ তার ধ্যান জ্ঞান ছিল ফুটবল, এবং এ খেলায় তিনি ছিলেন বেশ দক্ষ। তার দক্ষতা দিয়ে ১২ বছর বয়সেই তিনি স্কটল্যান্ড এর টপ ফুটবল ক্লাব গ্লাসগো রেঞ্জারসে জায়গা করে নিয়েছিলেন। মূলত ঘরের কঠিন পরিবেশ থেকে বাঁচতে, এবং নিজের মতো করে একটা পরিচয় গড়ে নিতে ফুটবলকে ধ্যান জ্ঞান বানিয়ে নিয়েছিলেন তিনি।
তবে নিজের এই স্বপ্নকে খুব বেশিদিন ধরে রাখতে পারেননি তিনি। ১৫ বছর বয়সে খেলতে গিয়ে হাঁটুতে বেশ গুরুতর আঘাত পান। এই আঘাত নিয়ে বেশ অনেকদিন ভুগতে হয়েছে র্যামসেকে। তার ফুটবল ক্যারিয়ারও এর কারণেই শেষ হয়ে যায়। তার ভবিষ্যৎ কে পালটে দেয়ায় এটা বেশ প্রভাব ফেলে।
মূলত ইনজুরির পরেই গর্ডন নিজের জীবনের লক্ষ্য পাল্টে ফেলতে বাধ্য হন। ছোটবেলা থেকেই তার রান্নার দিকে কিছুটা আগ্রহ ছিল। মাকে কিচেন এর সাহায্য করতে গিয়ে বেশ অভিজ্ঞতাও হয়েছিল তার। সেখান থেকে এবং পরিবারের বাকিদের উৎসাহ পেয়ে রান্নাকে আরো সিরিয়াসলি নিতে শুরু করেন গর্ডন র্যামসে। তার এনার্জি এবং ক্রিয়েটিভিটিকে কাজে লাগিয়ে রান্না করে পারদর্শী হয়ে ওঠেন তিনি।
রান্না নিয়ে আরও সামনে এগোতে নর্থ অক্সফোর্ড শায়ার টেকনিক্যাল কলেজের হোটেল ম্যানেজমেন্ট কোর্সে ভর্তি হন। এবং এর মাধ্যমেই রন্ধন শিল্পের জগতে তার ফরমাল ট্রেনিং শুরু হয়।
পুরোপুরি রান্নায় মগ্ন হওয়া
রান্নার টেকনিক্যাল কোর্সে ভর্তি হওয়ার পরে র্যামসে ধীরে ধীরে হসপিটালিটি ইন্ডাস্ট্রির সবকিছু, রান্না, কিচেন ম্যানেজমেন্ট, কাস্টমার সার্ভিস সবকিছুর উপর এই ট্রেনিং পেয়েছিলেন। বলা যেতে পারে এজন্যই শুধু রান্না নয়, রেস্টুরেন্ট চালানোর সব ক্ষেত্রেই গর্ডন র্যামসে পারদর্শী। এবং কুকিং শো এর মাধ্যমে বেশ কিছু প্রায় বন্ধ হয়ে যাওয়া রেস্টুরেন্টকে আবার ব্যবসায় ফিরিয়ে আনতে পেরেছেন তিনি।
এ পর্যায়ে তার শিক্ষা জীবনের একটি বেশ গুরুত্বপূর্ণ কাহিনী বলা যায়। এক দিন প্র্যাকটিক্যাল রান্নার ক্লাসের সময় ইন্সট্রাক্টর এর সামনে থেকে খুব বেসিক একটা রান্না করতে বলা হয়। তিনি খুব কনফিডেন্সের সাথে রান্না প্রেজেন্ট করেছিলেন, এবং তার ধারণা ছিল তার ন্যাচারাল ট্যালেন্ট এবং পরিশ্রমের সাহায্যেই তার রান্না ভালো হবে। কিন্তু যখন ইন্সট্রাক্টর তার রান্নাটি টেস্ট করেন, তখন বেশ ভালই সমালোচনার মুখোমুখি হন র্যামসে। বেশ কিছু ভুল রয়ে গিয়েছিল তার রান্নায়। টেস্ট, কুকিং টেকনিক এই সবে সামান্যই ভুল ছিল। এর মাধ্যমেই গর্ডন র্যামসে বুঝতে পারেন যে রান্নার দুনিয়ায় অনেক কিছুই এখনো তার অজানা রয়ে গিয়েছে। এখানে সবকিছু হতে হয় একদম পারফেক্ট এবং ডিটেইলড, যেটা করতে হলে অনেক পরিশ্রম এবং প্র্যাকটিস দরকার, শুধুমাত্র ন্যাচারাল ট্যালেন্ট আর দক্ষতায় কাজ হবে না।
তবে এই অভিজ্ঞতায় তিনি একদমই হতাশ হননি। বরং দ্বিগুণ উদ্যমে ঝাঁপিয়ে পড়েছেন নিজের কাজে। পড়াশোনার পেছনে অতিরিক্ত সময় দেওয়া, আরো বেশি সিরিয়াস হয়ে কিচেনের কাজকর্ম করা, জানা টেকনিক বারবার প্র্যাকটিস করে একদম পারফেক্ট করার চেষ্টা করা, এবং ক্রমাগত ইন্সট্রাক্টরদের পরামর্শ নিতে থাকা তাকে ধীরে ধীরে আরো দক্ষ করে তোলে। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন যে রান্নার জ্ঞান পরিবর্তন হতে থাকে, এবং নতুন নতুন অনেক কিছুই এতে যোগ হয়। তাই এই ফিল্ডে শিক্ষার কোনো শেষ নেই বরং প্রতিটি জিনিসই হতে হবে একদম পারফেক্ট।
যে কারণে হয়তো আমরা মাঝেমধ্যে র্যামসেকে তার অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণকারী প্রতিযোগীদের প্রতি একটু বেশি কঠোর হতে এবং তাদের কাজের সমালোচনা করতে দেখি। কিন্তু এটা কোনোভাবেই তাদেরকে নিরুৎসাহিত করা অথবা তাদের ছোট করার জন্য নয়, বরং তাদেরকে পরবর্তী ধাপের জন্য তৈরি করা, এবং তাদের মধ্যে আরো বেশি করে চেষ্টা করার মনোভাব তৈরি করে দেওয়ার জন্য।
কর্মজীবনে পা রাখা
পড়াশোনা শেষ করার পর একজন শেফ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হতে র্যামসের দরকার ছিল সরাসরি অভিজ্ঞতা, যা পাবার একমাত্র উপায় ছিল প্রফেশনাল কিচেনে অন্যান্য শেফদের সাথে কাজ করা। কর্মজীবনের শুরুতে গর্ডন র্যামসে অক্সফোর্ডশায়ারের বানব্যারিতে রকস্টন হাউস হোটেল নামে একটি রেস্টুরেন্টে জুনিয়র শেফ হিসেবে জয়েন করেন। এখানে মূলত তার কাজ ছিল অন্যান্য বড় বড় শেফদের কাজে সাহায্য করা, ফুড প্রিপারেশনের সাধারণ কাজকর্মগুলো করা এবং একই সাথে রেস্টুরেন্টের ভেতরের কাজকর্ম শিখে নেওয়া। রকস্টন হাউজের পর তিনি উইকহ্যাম আর্মসে কাজে যোগ দেন, যেখানে তার প্রধান কাজ ছিল কিচেন ম্যানেজ করা এবং মেন্যু ঠিক করা। এই কাজে তার দক্ষতা ও ক্রিয়েটিভিটি প্রকাশ করার যথেষ্ট জায়গা না থাকায় কিছুদিনের মধ্যেই তিনি বিরক্ত হয়ে পড়েন। তাই নিজের ক্ষমতাকে কাজে লাগাতে এবং আরো ভালোভাবে শিখতে তিনি লন্ডনের পথে পা বাড়ান।
প্রফেশনাল শেফ হিসেবে যাত্রা
১৯৮৭ সালে ২১ বছর বয়সে গর্ডন র্যামসে লন্ডনের হার্ভিস রেস্টুরেন্টে কাজে যোগ দেন। সেখানে তিনি বিখ্যাত শেফ মার্কো পিয়ারে হোয়াইটের আন্ডারে কাজ করতে শুরু করেন। মার্কো ছিলেন মাত্র ৩৩ বছর বয়সে তিনটি মিশেলিন স্টার পাওয়া শেফ, যা তাকে ইউকের ইতিহাসে সবচেয়ে কম বয়সে ৩টি মিশেলিন স্টার পাওয়া শেফ হিসেবে খ্যাতি দিয়েছিল। মার্কোর কিচেনে সবসময়ই ছিলো কাজের চাপে উত্তেজনার পরিবেশ, এবং প্রতিটি কাজই করতে হতো একদম পারফেক্ট ভাবে। জুনিয়রদের ভালই চাপ দিতেন মার্কো। এখানেও জুনিয়র সেফ হিসেবে জয়েন করলেও ধীরে ধীরে সূক্ষ্মতা, দক্ষতা, দ্রুততা এবং ক্রিয়েটিভিটির গুরুত্ব শিখে নেন র্যামসে।
মার্কো পিয়েরে হোয়াইট এর বিশেষত্ব ছিল ফাইন ডাইনিং এবং ক্লাসিক টেকনিক। মূলত সেই সব বিষয়েই হাত পাকাতে চেয়েছিলেন গর্ডন র্যামসেও। পিয়েরের সাথে কাজ করতে করতে তিনি ফ্লেভার কম্বিনেশন এর গুরুত্ব, উচ্চমানের ইনগ্রেডিয়েন্ট ব্যবহার এবং খাবারকে সুন্দর করে প্রেজেন্ট করার গুরুত্ব বুঝতে পারেন, এবং সে অনুযায়ী নিজের শিক্ষা বাড়িয়ে নিতে থাকেন। তবে এই শেখার পথ ছিল না সহজ। পিয়েরে কুখ্যাত ছিলেন তার প্রচন্ড খারাপ মেজাজ এবং তার ছাত্রদের উপর অনেক বেশি এক্সপেক্টেশন এর প্রেশার দেয়ার জন্য। কারণে কিচেনের পরিবেশ বেশিরভাগ সময়ই থাকতো টানটান, এবং প্রায়ই চেঁচামেচি শোনা যেত। পরিবেশে থেকেও গর্ডন র্যামসে তার ট্রেনিংয়ের গুরুত্ব বুঝতে পারেন, এবং মনোযোগ দিয়ে নিজের সর্বোচ্চ চেষ্টা করেন যতটুকু পারেন শিখে নেয়ার। তবে সব সময় তা সহজ হতো না, এ প্রসঙ্গে একটা ঘটনা বলা যায়, যা থেকে গর্ডন র্যামসের এখনকার স্বভাব ও ব্যবহারের কিছুটা ব্যাখা পাওয়া যায়।
একদিন খুব ছোট একটা ভুলের কারণে মার্কো হোয়াইট গর্ডন র্যামসেকে কাঁদিয়েছিলেন। এই ঘটনাটি গর্ডন নিজের অটোবায়োগ্রাফিতে লিখেছেন। একটা পাস্তা অর্ডারে ছোট একটা ভুল হওয়ায় মার্কো হোয়াইট তার সাথে প্রচন্ড চেঁচামেচি করেন, যার কারণে র্যামসে পিছন থেকে বেরিয়ে চলে যাচ্ছিলেন। হোয়াইট তার পিছনে পিছনে যান, এবং তাকে কোনো রকমের স্বান্তনা না দিয়ে জোর করে কিচেনে ফিরিয়ে এনে ভুল শুদ্ধ করতে বাধ্য করেন। এ ঘটনায় তিনি কেঁদে দিয়েছিলেন। একটি অপ্রীতিকর স্মৃতি হলেও, এ ধরনের ঘটনা র্যামসেকে জীবনে বেশ ভালো শিক্ষা দিয়েছিল, এবং তিনি মনে করেন তার বর্তমান পারফেকশন ও কোয়ালিটির প্রতি অবসেশন এর পেছনে এই ঘটনাগুলোর ভূমিকা আছে।
পরবর্তী গন্তব্য
হার্ভিস এ গর্ডন র্যামসে ছিলেন প্রায় তিন বছর, তারপর তিনি নতুন চ্যালেঞ্জ এবং অভিজ্ঞতা আরো বাড়ানোর উদ্দেশ্যে হার্ভিস ছাড়ার সিদ্ধান্ত নেন এবং তার গুরু মার্কো পিয়েরে হোয়াইটকে জানান। হোয়াইট তার এই সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানান এবং তার পরিচিত ফ্রেঞ্চ শেফদের সাথে কাজ করার সুযোগ ও তৈরি করে দেন।
ফ্রান্স যাওয়ার আগে লন্ডনের রসমোর রেস্টুরেন্টে স্যু শেফ হিসেবে বেশ কিছুদিন কাজ করেছিলেন তিনি, নিজের অভিজ্ঞতা বাড়িয়ে নেয়ার জন্য। রেস্টুরেন্টে তখন রিব্র্যান্ডিং চলছিলো, কাজেই সেখানে কাজের চাপও ছিল প্রচন্ড। এর ফলে তিনি রান্নার পাশাপাশি ক্রিটিক্যাল টাইমে রেস্টুরেন্ট চালানো ও একইসাথে কুকিং ও ম্যানেজমেন্ট এর কাজ করার অভিজ্ঞতা পান। এখানে কাজ শেষ করার পর তিনি ফ্রান্স যাত্রা করেন।
ফ্রান্সে আসা ও ফ্রেঞ্চ টেকনিক ভালোভাবে রপ্ত করা
১৯৯০ সালে র্যামসে প্যারিসে পা রাখেন এবং সেখানকার সবচেয়ে বিখ্যাত ও সম্মানীয় কয়েকজন শেফ এর সাথে কাজ করেন। তার মধ্যে সর্বপ্রথম ছিলেন গাই স্যাভয়। গাই স্যাভয় বিখ্যাত হয়েছিলেন নতুনভাবে ফ্রেঞ্চ রান্নার জন্য। ট্র্যাডিশনাল ফ্রেঞ্চ রান্নার টেকনিকে কনটেম্পোরারি স্টাইল এর কম্বিনেশন চালু করেছিলেন তিনি। তখনই তার ঝুলিতে তিনটি মিচেলিন স্টার। র্যামসে তার মেন্টর হিসেবে বিভিন্ন জায়গায় স্যাভয় এর নাম বলেছেন এবং তাকে সম্মান দিয়েছেন। তার ভাষ্যমতে ফ্রেঞ্চ কুইজিনের স্বভাবগত সূক্ষ্মতা এবং বিশেষত্ব তিনি স্যাভয়ের কাছেই শিখেছেন।
ফ্রেঞ্চ রান্নায় ফ্লেভার এবং টেক্সচারের পারফেক্ট ব্যালেন্স করতে পারা খুব গুরুত্বপূর্ণ, এবং এ কাজে বেশ দক্ষতার প্রয়োজন হয়। স্যাভয় এর কাছে র্যামসে সেই টেকনিক সম্পর্কেই শিক্ষা পান। একই সাথে ফাইন ডাইনিং এবং ছোটখাটো ডিটেইলের প্রতি পূর্ণ মনোযোগ দেয়া, হাই স্ট্যান্ডার্ড বজায় রাখার ট্রেনিং নেন।
যেখানে হোয়াইটের সাথে র্যামসের অভিজ্ঞতা ছিল তিক্ত, সেখানেই গাই স্যাভয় সম্পর্কে র্যামসের মনে আছে কেবলই প্রশংসা ও কৃতজ্ঞতা। রান্নায় তার নিজের এপ্রোচ অনেকটাই স্যাভয়ের কৃতজ্ঞতা বলে মনে করেন তিনি, বিশেষত তার নিজের দক্ষতাকে মিচেলিন স্টার লেভেলের করে তোলার ক্ষেত্রে। এ সম্পর্কে তার বই “দ্য হাম্বল পাই” এ তিনি বিস্তারিত লিখেছেন।
স্যাভয়ের সাথে কাজ করার পর র্যামসে আরেক বিখ্যাত ও দক্ষ শেফ জোয়েল রবুচন এর সাথে কাজ করেন। জোয়েল বিখ্যাত ছিলেন তার সিম্পলিসিটি, মিনিমাল ইলিগ্যান্স ও পারফেক্ট রান্নার জন্য। তার রান্নাগুলো খুব জটিল কিছু ছিল না, সাধারণ। কিন্তু সেই সাধারণকেই অনন্য করে তোলা ছিল জোয়েলের দক্ষতা। এখানে এসে র্যামসে ভালো মানের ইনগ্রেডিয়েন্ট রান্নার স্বাদে কিভাবে পরিবর্তন আনে, সাধারণ একটা রান্নাকে কিভাবে অতুলনীয় করে তোলা যায়, এবং খাবার প্লেটে একগাদা ডেকোরেশন না করে খুব সাধারণভাবে সাজিয়েও কিভাবে আকর্ষণীয় ও লোভনীয় করে তোলা যায়, এ সম্পর্কে শিক্ষা নেন।
এ প্রসঙ্গে একটা মজার গল্প শেয়ার করা যায়। জোয়েল রবুচন র্যামসের মেধা ও দক্ষতার প্রশংসা করলেও, তার মেজাজ আর আচরণকে সহ্য করা কঠিন বলে মন্তব্য করেছেন। একদিন একটা পাস্তা ডিশ রান্নায় ভুল হওয়ায় রবুচেন র্যামসেকে সেটা নতুন করে করতে বলেছিলেন। র্যামসে তা না করে কিছু বাসনপত্র প্রচন্ড শব্দ করে এলোমেলো করে ফেলেন এবং চাকরি ছাড়ার হুমকি দেন। এতে রবুচন ধৈর্য হারিয়ে পাস্তার প্লেটটি র্যামসের দিকে ছুড়ে দেন। দি টেলিগ্রাফ এ দেয়া এক সাক্ষাৎকারে হাসতে হাসতে রবুচন জানান, “সেটাই ছিল আমার জীবনে প্রথম ও শেষ কারো দিকে খাবারের প্লেট ছুঁড়ে মারা।”
ফ্রান্সে র্যামসের অভিজ্ঞতা ও প্রতিবন্ধকতা
একজন বহিরাগত হিসেবে র্যামসের ফ্রান্সে যাওয়া এবং সেখানে কাজ শেখা সহজ ছিল না মোটেও। ইউকের পরিবেশ আর ফ্রান্সের পরিবেশের মধ্যে অনেক পার্থক্য ছিল। এছাড়াও ভাষা এখানে বেশ বড় একটা মাধ্যম। ল্যাঙ্গুয়েজ ব্যারিয়ার এর কারণে বেশ সমস্যায় পড়েছিলেন তিনি সেখানে। এছাড়াও কাজের চাপ, প্রচন্ড চাপের মধ্যেও সেরা কাজ দেওয়া সেখানে ছিল রোজকার ঘটনা। পৃথিবীর সবচেয়ে বিখ্যাত শেফদের সাথে তাদের কিচেনে কাজ করতে করতে কাজের গতি এবং দক্ষতা একই সাথে বাড়িয়ে নেওয়া শিখতে হয়েছে তাকে। তা সত্ত্বেও নিজের কাজ এবং শখ থেকে পিছিয়ে যাননি তিনি। কাজ যত কঠিনই হতে থাকুক, তার সাথে পাল্লা দিয়ে পরিশ্রম করেছেন তিনি।
এ সময় প্রয়োজন অনুযায়ী অতিরিক্ত কাজও নিয়েছেন তিনি। প্রাইভেট শেফ হিসেবে কাজ করেছিলেন ইয়ট এও। বিভিন্ন পরিস্থিতিতে বিভিন্ন জায়গায় কাজের অভিজ্ঞতা পেতে এসব পদক্ষেপ নিয়েছিলেন র্যামসে।
তিন বছর কঠোর পরিশ্রম করে ১৯৯৩ সালে লন্ডনে ফেরত আসেন গর্ডন র্যামসে। তিন বছর আগের র্যামসে আর এই র্যামসের মধ্যে পার্থক্য আকাশ পাতাল। তার এই তিন বছরের অভিজ্ঞতায় তার দক্ষতা, সূক্ষ্মতা আর কাজের মান সবকিছুই বেড়েছে। বিশ্ব বিখ্যাত শেফদের সাথে কাজের প্রভাবে তার রান্নার স্টাইলে নতুনত্ব এসেছে। ট্রেডিশনাল কুকিং এবং ইনোভেটিভ কুকিং এর কম্বিনেশন নিয়ে কাজ করার সাথে সাথে প্লেটিং টেকনিক, ইনগ্রেডিয়েন্ট এর কোয়ালিটি এবং পরিমাণ, রান্নার বিভিন্ন মেথড এসব নিয়েও বেশ অভিজ্ঞতা জন্মেছে তার। এই অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে অবশেষে জীবনের নতুন অধ্যায়ে প্রবেশ করেন গর্ডন র্যামসে।
লন্ডনে নতুন যাত্রা শুরু
লন্ডনের ফেরার পর গর্ডন র্যামসে আওবারজিন রেস্টুরেন্টে হেড শেফ হিসেবে যোগ দেয়ার অফার পান। আওবারজিন ছিল চেলসিতে অবস্থিত একদমই নতুন একটি রেস্টুরেন্ট। এই সুযোগ আসে তার মেন্টর মার্কো পিয়েরে হোয়াইট এর হাত ধরে। নতুন রেস্টুরেন্টে খোলার পেছনে তার ভালোই ভূমিকা ছিল, এবং র্যামসের মেধা ও দক্ষতার উপর ভরসা করে তিনি এই সুযোগটি তাকে অফার করেন।
হেড শেফ হিসেবে র্যামসের ছিল বিভিন্ন রকমের কাজ ও দায়িত্ব। মেন্যু ঠিক করা, শেফদের নির্দেশনা দেওয়া থেকে শুরু করে আওবারজিনকে একটি সুন্দর এবং হাই ক্লাস ডাইনিং স্পেস হিসেবে গড়ে তোলা, এর পুরোটাই তার উপরে পড়েছিল। এর আগে বিভিন্ন জায়গায় ট্রেনিং এ পাওয়া অভিজ্ঞতা, হাইভোল্টেজ পরিবেশে দক্ষ ডিসিশন নেয়ার ক্ষমতা, এবং শেফ হিসেবে নিজের দক্ষতাকে কাজে লাগিয়ে এই চ্যালেঞ্জ র্যামসে নেন।
র্যামসের নেতৃত্ব, দক্ষতা ও অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগানোর ফলে খুব দ্রুতই আওবারজিন বিখ্যাত হয়ে পড়ে। এর চমৎকার পরিবেশ, ভালো মানের খাবার এবং কাস্টমার ফ্রেন্ডলি সার্ভিসের কথা সব জায়গায় ছড়িয়ে পড়ে। ওপেনিংয়ের মাত্র ১৪ মাসের মধ্যেই গর্ডন র্যামসের হাত ধরে আওবারজিন পায় প্রথম মিচেলিন স্টার। রান্নার জগতের সর্বোচ্চ সম্মান এই মিচেলিন স্টার। দুই বছর পর দ্বিতীয় মিচেলিন স্টার পেয়ে গর্ডন র্যামসের নাম ব্রিটেনের সবচেয়ে বিখ্যাত শেফদের তালিকায় চলে আসে।
মূলত র্যামসের নতুন শিখে আসা বিদ্যা, ক্লাসিক্যাল ফ্রেঞ্চ টেকনিকের সাথে নতুনত্ব এবং কনটেম্পোরারি মিশ্রণ তার ডিশগুলো সবার থেকে আলাদা করে তুলেছিল। ক্রিয়েটিভিটি, ব্যালেন্স, এবং এক্সিকিউশনের জন্য বিভিন্ন জায়গায় তার মেন্যুর উদাহরণ দেওয়া হত। সাধারণ কাস্টমার, হাই ক্লাস কাস্টোমার এবং ফুড ক্রিটিক, সবার মাঝেই তার রেস্টুরেন্টের সুনাম ছড়িয়ে পড়ে, মানুষের পছন্দের তালিকায় প্রথম দিকে চলে আসে। একই সাথে ছড়ায় তার সুনাম আর খ্যাতিও।
তবে, সফলতা আর খ্যাতি থাকা সত্ত্বেও আওবারজিন এ বেশিদিন থাকতে পারেননি গর্ডন র্যামসে। রেস্টুরেন্ট চালানো ও টাকাপয়সা সংক্রান্ত ব্যাপার নিয়ে ইনভেস্টরদের সাথে তার বিরোধ দেখা দেয়। র্যামসে শুধুমাত্র হেড শেফ হয়েই থাকতে চাননি, রেস্টুরেন্টের অংশীদারিত্বের একটা বড় অংশ চেয়েছিলেন। তার ভাষ্যমতে, তার নিয়ন্ত্রণ যদি বাড়ে রেস্টুরেন্টের সাফল্যের হারও বাড়বে। কিন্তু বাকি ইনভেস্টররা তার এই দাবি মেনে নেননি। এর মধ্যে তার মেন্টর মার্কো পিয়েরে হোয়াইটও ছিলেন। তারা আওবারজিনকে একটা চেইন রেস্টুরেন্টে পরিণত করতে চেয়েছিলেন, যেখানে র্যামসে চেয়েছিলেন এটাকে একটা বিখ্যাত হাই-এন্ড রেস্টুরেন্টে পরিণত করতে। এছাড়া র্যামসে দাবি করেন যে, তিনি জানতে পেরেছিলেন প্রিমিয়াম চার্জ করা সত্ত্বেও রেস্টুরেন্টের জন্য নিম্নমানের ইনগ্রেডিয়েন্ট কেনা হচ্ছে, যেটার তিনি পুরোপুরি বিরুদ্ধে ছিলেন। এইসব ঝামেলা দিন দিন বাড়তে থাকে, অবশেষে ১৯৯৮ সালে আওবারজিন ছেড়ে গর্ডন র্যামসে চলে আসেন এবং নিজস্ব রেস্টুরেন্ট শুরু করেন। আওবারজিন এর বেশিরভাগ স্টাফও তার সাথেই চলে এসেছিলেন।
র্যামসে চলে আসার পরে কিছুদিন চললেও আওবারজিন এর সেই সোনালি দিন আর কখনোই ফেরত আসেনি। আগের মত হাই স্ট্যান্ডার্ড মেইন্টেইন করতে হিমশিম খায় রেস্টুরেন্টটি। পরবর্তীতে উইলিয়াম ড্রাবল এর হাত ধরে আরেকটি মিচেলিন স্টার পেলেও আগের মত লেভেল না রাখতে পারায় মিচেলিন স্টার হারায় আওবারজিন। সময়ের সাথে সাথে এর খ্যাতিও কমে যেতে থাকে, অবশেষে ২০১০ সালে একেবারেই বন্ধ হয়ে যায় আওবারজিন।
স্বপ্নপূরণ – নিজের নামে নিজের রেস্টুরেন্ট
১৯৯৮ সালে আওবারজিন থেকে চলে আসার পর র্যামসে তার স্বপ্ন পূরণের কাজে হাত দেন। লন্ডনের চেলসিতে রয়াল হসপিটাল রোডে তিনি তার নিজস্ব রেস্টুরেন্ট গড়ে তোলেন, নাম হয় রেস্টুরেন্ট গর্ডন র্যামসে। নিজের এত বছরের অভিজ্ঞতা, এমবিশন ও দক্ষতাকে কাজে লাগিয়ে র্যামসে একটি শক্ত দল গড়ে তোলেন, যার মধ্যে তার আগের রেস্টুরেন্ট থেকে তার সাথে চলে আসা কলিগরাও ছিলেন। সম্পূর্ণ নিজস্ব ভিশনে ডাইনিং এক্সপেরিয়েন্স তৈরি করতে র্যামসে কাজে লেগে পড়েন।
তার ফ্রান্স থেকে শিখে আসা বিদ্যা এক্ষেত্রে তিনি খুব ভালোভাবেই প্রয়োগ করেন। তার নতুন রেস্টুরেন্টের মূল ফোকাস ছিল ফ্রেঞ্চ ইন্সপায়ারড কুইজিন এ। তার সাথে তিনি যোগ করতেন তার নিজস্ব নতুনত্ব, এবং ইনগ্রেডিয়েন্টের কোয়ালিটিতে তিনি কখনোই কম্প্রোমাইজ করেননি। ছোটখাটো ব্যাপারের প্রতি তার তীক্ষ্ণ চোখ তার রেস্টুরেন্টের স্ট্যান্ডার্ডকে অনেক উপরে নিয়ে যায়। এছাড়াও বিভিন্ন সিজন অনুযায়ী বিশেষ আইটেমও থাকত তার রেস্টুরেন্টে। তার রেস্টুরেন্টের ডাইনিং এক্সপেরিয়েন্স, সার্ভিস, ফুড ও প্রেজেন্টেশন, সবকিছু নিয়েই কাস্টমাররা কেবল প্রশংসাই করেছেন। যা তার নতুন রেস্টুরেন্টের খ্যাতি খুব অল্পদিনেই ছড়িয়ে দিয়েছে।
প্রিমিয়াম এবং ফাইন ডাইনিং এর ডেস্টিনেশন হিসেবে সারা লন্ডনে খুব দ্রুতই গর্ডন র্যামসে রেস্টুরেন্ট এর নাম ছড়িয়ে পড়ে। ২০০১ সালে রেস্টুরেন্ট খোলার তিন বছরের মধ্যেই প্রথম স্কটিশ সেফ হিসেবে গর্ডন র্যামসে অর্জন করেন তার তৃতীয় মিচেলিন স্টার। রান্নার জগতে তিনটি মিচেলিন স্টার পাওয়া খুব উঁচু মানের সম্মানীয় একটি বিষয়। এর মাধ্যমে গর্ডন র্যামসের নাম পৃথিবীর সবচেয়ে বিখ্যাত শেফদের মধ্যে একজন হিসেবে ছড়িয়ে পড়ে, এবং তার ক্যারিয়ারের এটি ছিল অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ একটি মাইলস্টোন।
তারপর থেকে রেস্টুরেন্ট গর্ডন র্যামসে তার থ্রি স্টার রেটিং খুব ভালোভাবেই মেনটেইন করে আসছে, কোয়ালিটি এবং স্ট্যান্ডার্ড এর সাথে কোনো রকমের কম্প্রোমাইজ করা গর্ডনের পছন্দ নয়, তাই তার রেস্টুরেন্টগুলোর সুনাম হয় আগের মতই আছে, না হয় সময়ের সাথে সাথে আরো বেড়েছে।
রেস্টুরেন্ট গর্ডন র্যামসের সাফল্যের সাথে সাথে অন্যান্য দিকেও পায়ের ছাপ রাখতে শুরু করেন গর্ডন র্যামসে। ১৯৯৯ সালেই মার্কাস ওয়ারিং এর সাথে মিলে লন্ডনের সেইন্ট জেমসে “পেট্রুস” নামে আরেকটি রেস্টুরেন্ট চালু করেন তিনি। পেট্রোসের বিশেষত্ব ছিল এর মডার্ণ ইউরোপিয়ান কুইজিন এবং রুচিশীল পরিবেশ। এক বছরের মধ্যেই পেট্রুসও পেয়ে যায় নিজস্ব মিচেলিন স্টার।
২০০০ সালের শুরু থেকেই লন্ডনের বিভিন্ন জায়গায় র্যামসে নতুন নতুন রেস্টুরেন্ট খুলতে থাকেন। এদের প্রত্যেকটাই ছিল অত্যন্ত হাই স্ট্যান্ডার্ড মেইনটেইন করা রেস্টুরেন্ট, যার কারণে খুব অল্প সময়ে খ্যাতি ছড়িয়েছে প্রত্যেকটাই। এছাড়াও বিস্ট্রো, পিজ্জা ও বার্গার চেইন এ ধরনের সাধারণ রেস্টুরেন্ট চেইন নিয়েও গর্ডন র্যামসে কাজ করেছেন, এর ফলে সব স্তরের কাস্টমারদের মধ্যেই তার নাম ছড়িয়ে গেছে।
আন্তর্জাতিক অঙ্গনে যাত্রা
ইউকে তে নিজের মেধা ও দক্ষতার ছাপ ফেলার পর গর্ডন র্যামসে এবার আন্তর্জাতিক পর্যায়ে যাওয়ার চিন্তা-ভাবনা করেন। দুবাইয়ের হিল্টন দুবাই ক্রিক হোটেলে ২০০১ সালে তার প্রথম আন্তর্জাতিক রেস্টুরেন্ট “ভেরে” চালু করেন তিনি। মিডল ইস্টার্ন এলাকায় মডার্ন ইউরোপীয় কুইজিন নিয়ে চালু হওয়ার রেস্টুরেন্টটি খুব দ্রুতই সুনাম ছড়িয়ে নিজের জায়গা করে নেয়। এছাড়াও ২০০৮ সালে ফ্রান্সের ভার্সেইলেস এ ট্রিয়া নন প্যালেস এবং ২০০৭ সালে চেক রিপাবলিকে মেজ প্রাগ নামে আরো দুইটি রেস্টুরেন্ট চালু করেন তিনি। এছাড়াও এশিয়ার হংকং, সিঙ্গাপুর, মাকাও, অস্ট্রেলিয়ার মেলবোর্ন সাউথ আফ্রিকার কেপটাউনেও নিজের প্রতিভা ছড়িয়েছেন গর্ডন র্যামসে।
২০০৬ সালে আমেরিকায় নিজের রেস্টুরেন্ট চালু করা ছিল র্যামসের ইন্টারন্যাশনাল ক্যারিয়ারের বেশ গুরুত্বপূর্ণ একটি চ্যাপ্টার। নিউইয়র্ক সিটির দি লন্ডন হোটেলে আরেকটি রেস্টুরেন্ট গর্ডন র্যামসে চালু করেন তিনি। এটিতে মূলত হাই ক্লাস ব্রিটিশ এবং ফ্রেঞ্চ কুইজিন নিয়ে কাজ করা হয়, প্রথম বছরেই এই রেস্টুরেন্টও পেয়ে যায় দুইটি মিচেলিন স্টার।
তবে আমেরিকায় শুধুমাত্র হাই এন্ড রেস্টুরেন্ট নিয়েই কাজ করেনি গর্ডন র্যামসে। তার ভাষ্যমতে, এখানকার কাস্টমাররা আরেকটু ঘরোয়া, সহজ এবং ইনফরমাল পরিবেশ পছন্দ করে। তাই আমেরিকান স্টেক হাউস স্টাইলে গর্ডন র্যামসে স্টেক, ব্রিটিশ পাবকে মাথায় রেখে গর্ডন র্যামসে গ্রিল এবং আমেরিকানদের ফাস্টফুডের প্রতি ভালবাসাকে মাথায় রেখে গর্ডন র্যামসে বার্গার চালু করেন তিনি।
কিছু মজার তথ্য
এই কঠিন পরিশ্রম আর বাধা বিপত্তি পেরিয়ে এগিয়ে যাওয়ার মধ্যেও তার সম্পর্কে রয়েছে বেশ কিছু মজার তথ্য এবং ঘটনা, তার মধ্যে কয়েকটি শুনলে আপনি হয়তো অবাক হয়ে যাবেন!
* গর্ডন র্যামসে কিচেনে তার প্রথম চাকরি ছেড়ে দিয়েছিলেন, কারণ তার বসের বউয়ের সাথে তার সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল। তার বয়স ছিল মাত্র ১৯ বছর, এবং তার ভাষ্যমতে তিনি ব্যাপারটা এড়াতে পারেননি। এ ঘটনার পরে নিজ থেকেই তিনি চাকরি ছেড়ে দেন।
* গিনেস বুক অফ ওয়ার্ল্ড রেকর্ডে বর্তমানে চারটি রেকর্ড আছে তার। সেগুলো হলো,
১. এক মিনিট পাঁচ সেকেন্ড সময়ে ১০ পাউন্ডের একটি মাছকে পিলে করে ফেলা।
২. এক মিনিটে ১.৪৫ মিটারের পাস্তা সিট রোল করে ফেলা, ইতিহাসে যা সবচেয়ে লম্বা।
৩. বিশ্বের সবচেয়ে বড় বিফ ওয়েলিংটন বানানো, যার ওজন ছিল ২৫.৭৬ কেজি, লম্বা ছিল ২ ফুট ৫ ইঞ্চি, ১৩ ইঞ্চি এবং উঁচুতে ৮ ইঞ্চি। এ কাজে তার সাথে ছিলেন আরেক বিখ্যাত শেফ নিক ডিজিওভানি।
৪. এক মিনিটে এক হাতে সবচেয়ে বেশি ডিম ভাঙ্গা, এই কাজে ছিল দুই জনের টিম তিনি ও তার মেয়ে মাতিলদা, ২৯ টি ডিম ভেঙে ছিলেন দুইজন মিলে।
* ব্রিটিশ রাজ পরিবারের বেশ কয়েকজন বিখ্যাত সদস্যের জন্য রান্না করেছিলেন গর্ডন র্যামসে। তার খ্যাতি থেকেই তাকে হাই প্রোফাইল গেস্টদের সার্ভ করার জন্য নির্বাচন করা হয়েছিল। এদের মধ্যে ছিলেন প্রিন্সেস ডায়ানাও।
* ফুটবল ছেড়ে রান্নার জগতে এলেও খেলাধুলা বা শারীরিক কসরত একদমই বাদ দেননি গর্ডন র্যামসে। তিনি বেশ অনেকগুলো ম্যারাথন, ট্রায়াথলন, এবং আয়রন ম্যান কম্পিটিশন কমপ্লিট করেছেন। এছাড়াও তার শো “হেলস কিচেন” এ, একজন প্রতিযোগী তাকে মারার হুমকি দিলে তিনি জানান, তার কারাতে তে ব্ল্যাক বেল্ট আছে, এবং নিয়মিত বক্সিং ও করেন তিনি।
* ব্যাক্তিগত জীবনে পুরোপুরি একজন ফ্যামিলি ম্যান। ১৯৯৬ সালে তিনি বিয়ে করেন এলিজাবেথ হাচেসন (টানা) কে, এবং বর্তমানে ছয় সন্তান নিয়ে তিনি বেশ সুখী। তার মেয়ে টিলি মাতিলদা র্যামসে বাবার মতই রান্নার জগতকে বেছে নিয়েছে, ১৪ বছর বয়সেই “মাতিলদা এন্ড র্যামসে ব্রাঞ্চ” নামে তার নিজের কুকিং শো করেছে।
* নিজে সব সময় পারফেক্ট রান্না করা এবং তাতে উৎসাহ দিলেও, ফাস্ট ফুড এবং স্পাইসি খাবারের প্রতি তার আলাদা আগ্রহ রয়েছে। তিনি মাঝে মাঝে সুযোগ পেলেই ম্যাকডোনাল্ডে খেতে যান বলে স্বীকার করেছেন। এছাড়াও ইন্ডিয়ান ও থাই রান্না তার বিশেষ পছন্দ। তার প্রিয় সস হচ্ছে ঝাল সিরাচা সস। তবে ডাইভারসিটি পছন্দ হলেও রান্নায় ট্রাফল অয়েল, এবং পিজ্জায় আনারস এই দুটি জিনিস একদমই পছন্দ করেন না তিনি।
* তার নিজস্ব ক্যালিফোর্নিয়া ওয়াইনের লাইন রয়েছে, যার নাম গর্ডন র্যামসে ওয়াইন। ক্যালিফোর্নিয়ার মন্টেরেতে সীবোল্ড সেলারের মাস্টার সোমিলিয়ার ক্রিসমিলার এর সাথে কোলাবোরেশন করে তিনি নিজের এই ওয়াইন লাইন বের করেন। ২০ থেকে ৬০ ডলারের মধ্যে দাম হওয়ায় বেশ এফোর্ডেবল, এবং কোয়ালিটিতে কখনোই কম্প্রোমাইজ করেন না গর্ডন র্যামসে। তার ওয়াইন অর্গানিক এবং ভেগান ফ্রেন্ডলি।
* আমরা বেশিরভাগ সময় তাকে টিভি শোতে গালাগালি করা এবং চেঁচাতেই দেখি। কিন্তু এই চেঁচানোর প্রভাব পড়েছে তার উপরেও। তার টিভি শো তে শুটিং করার সময়ে অতিরিক্ত শব্দ এবং চেঁচামেচির কারণে তার বাম কানে কিছুটা সমস্যা দেখা দিয়েছে। তিনি বাম কানে কিছুটা কম শোনেন।
* তার শো “কিচেন নাইট মেয়ার” এ, মূলত তিনি প্রায় বন্ধ হয়ে যাওয়া রেস্টুরেন্টগুলোতে যান, তাদের খাবার টেস্ট করে, তাদেরকে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেয়ার দিক নির্দেশনা দেন। এ কাজ করতে গিয়ে রেস্টুরেন্টে খারাপ ও অপরিষ্কার পরিবেশে বানানো নিম্নমানের খাবার খেয়ে বেশ কয়েকবার তিনি খুব কঠিন ফুড পয়জনিং এর শিকার হয়েছিলেন।
* তার মেন্টর মার্কো পিয়েরে হোয়াইটের সাথে তার সম্পর্ক খুব একটা ভালো ছিল না। এরই মধ্যে হোয়াইট এর বিয়ের অনুষ্ঠানে র্যামসে কোনো অনুমতি নেয়া ছাড়া লুকিয়ে লুকিয়ে ঝোপঝাড় থেকে বিয়ের অনুষ্ঠান ভিডিও করেছিলেন, যার কিছু অংশ পরে তার টিভি শো “র্যামসে’স টিভি শো” তে প্রচার করা হয়। এ ঘটনায় মার্কো পিয়েরে খুবই রেগে যান, এবং গর্ডনের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করেন।
* বেশ আগের জেনারেশন এর হলেও সোশ্যাল মিডিয়ায় বেস্ট একটিভ গর্ডন র্যামসে। বিশেষত টিকটকে তার উপস্থিতি দেখার মত। বিভিন্ন রান্নার রেসিপি, কুইক রেসিপি, ফুড রিলেটেড টিপস শেয়ার করার সাথে সাথে, তিনি অন্যদের রান্নায় রিএকশন ভিডিওও করেন। মূলত হাস্যরসের মধ্য দিয়ে করা তার রান্না টেকনিকের সমালোচনা ও রিঅ্যাকশন ভিডিওগুলো তরুণ সমাজের মধ্যে বেশ জনপ্রিয়। এছাড়াও মাঝে মাঝে বিভিন্ন ভাইরাল ট্রেন্ড এবং চ্যালেঞ্জেও অংশ নিতে দেখা যায় তাকে।
* শুধু রান্না এবং রান্না রিলেটেড শো ছাড়াও বেশ কয়েকটি অ্যানিমেশন ও কার্টুন শোতে ভয়েস অ্যাক্টিং এ অংশ নিয়েছিলেন গর্ডন র্যামসে। পিনিয়াস এন্ড ফার্ব (২০১৮), বিগ হিরো সিক্সঃ দ্য সিরিজ (২০১৮), দি সিম্পসনস (২০১১) এবং স্মার্ফসঃ দ্য লস্ট ভিলেজ এই চারটি অ্যানিমে মুভি এবং কার্টুন শোতে গেস্ট হিসেবে ভয়েস অ্যাকটিং করেছিলেন তিনি।