কালচারাল শক | কেন হয় এবং কীভাবে কাটিয়ে ওঠা যায়?

কালচারাল শক কথাটি সবার কাছে পরিচিত না হলেও, যারা কাজের প্রয়োজনে বা যে কোনো কারণে নিজ এলাকার বাইরে গিয়ে থাকেন, তারা এই অভিজ্ঞতাটির সাথে পরিচিত। একজন মানুষ কীভাবে বহির্বিশ্বকে দেখবেন, এবং তার সাথে খাপ খাইয়ে নেবেন তার অনেকটাই নির্ভর করে তার নিজস্ব কালচার অথবা সংস্কৃতির উপরে। এটি মানুষের নিজস্ব সোশ্যাল সার্কেল এবং তার পরিচিত পৃথিবীর থেকে বের হয়ে নতুন অভিজ্ঞতা অর্জনে সহায়তা করে। মূলত সংস্কৃতির একটা বড় অংশ জুড়ে থাকে একই ধরনের বিশ্বাস, ব্যবহার ও ঐতিহ্য। সাধারণত আমরা যে সংস্কৃতির মধ্যে থাকি, বেড়ে উঠি এবং জীবনের বেশিরভাগ অংশ কাটিয়ে দেই, তার সম্পূর্ণ প্রভাবটা আমরা বুঝতে পারি না, যতক্ষণ না সরাসরি অন্য কোনো পরিবেশে আমরা যাচ্ছি। তাই আমরা যখন অন্য কোনো কালচারের সম্মুখীন হই, তখনকার প্রাথমিক অভিজ্ঞতা আমাদের জন্য অপরিচিত হতে পারে। যার কারণে আমরা কালচারাল শক পেতে পারি।

কালচারাল শক কী?

আমরা যখন জীবনের প্রয়োজনে নতুন কোনো জায়গা বা দেশে শিফট করি, তখন সেই জায়গার অনেক কিছুই আমাদের চোখে নতুন হয়ে ধরা দেয়। তাদের সংস্কৃতি, আচার আচরণ, তাদের ভাষা, পোশাক, খাদ্যাভ্যাস সবই আমাদের কাছে অন্যরকম লাগে। হঠাৎ এই পরিবর্তনের ফলে আমাদের যে ভিন্ন রকম অভিজ্ঞতা হয়, সেটাকেই আমরা কালচারাল শক বলতে পারি। উপরে উল্লেখিত কারণ ছাড়াও অনেক কারণেই কালচারাল শকের অভিজ্ঞতা হতে পারে। সামান্য অপরিচিত জিনিস থেকে শুরু করে অচেনা শহরে হারিয়ে যাওয়ার অভিজ্ঞতা, অথবা ওই এলাকার প্রচলিত প্রথার বাইরে ভুল করে ফেলা থেকেও এ ধরনের অনুভূতি হতে পারে। অপরিচিত পরিবেশে এ ধরনের অনুভূতি আসা খুবই স্বাভাবিক। কারণ আপনার নিজস্ব পরিচিত এলাকার মতো এখানে কোনো কিছুতেই আপনার কন্ট্রোল থাকে না। কালচারাল শক বেশ কিছু অস্বস্তিকর অনুভূতি নিয়ে আসে, যেমন উত্তেজনা, অনাগ্রহ, হতাশা, ভয় ইত্যাদি।

কালচারাল শক এর লক্ষণ

কালচারাল শকের বেশ কিছু লক্ষণ থাকে, যাতে আপনি বুঝতে পারবেন যে আপনি স্বাভাবিক বোধ করছেন না, অথবা আপনার আশেপাশে এমন কিছু হয়েছে যে কারণে আপনি ভালো নেই। বেশ কিছু লক্ষণ নিয়ে আমরা এখানে আলোচনা করছি।

ক্লান্তি

সব সময় খুব ক্লান্ত লাগবে, সারারাত ভালো ঘুম হলেও এই ক্লান্তি ভাব কাটবে না। নিয়ম মতো খাওয়া-দাওয়া এবং অন্যান্য সব কিছু মেনে চলার পরেও শরীর ভালো লাগবে না, অস্বস্তি লাগবে, কখনো কখনো বমি ভাবও হতে পারে।

খুব বেশি বিরক্তি 

খুব অল্পেও প্রচন্ড বিরক্ত বোধ হবে। কেউ খুব হালকা কোনো মজা করলে, অথবা প্রতিদিনকার রুটিনের সামান্য কিছু ভুল হয়ে গেলেও স্বাভাবিকের চেয়ে অনেক বেশি বিরক্তি এবং রাগ আসবে। মনোভাব অনেকটাই নেতিবাচক হয়ে যায়, যে কোনো কিছুতে সবচেয়ে খারাপটাই আশা করার প্রবণতা চলে আসে। যেমন নতুন এলাকায় গিয়ে হারিয়ে যাওয়া, ভুল ক্লাসরুমে বা অফিসে ঢুকে পড়া, প্রতিবেশীর সাথে খামোখাই ঝগড়া হওয়া এসবের ভয় মনে ঢুকে পড়ে।

ডিপ্রেশন বা হতাশা 

কালচারাল শকের খুব কমন একটি কারণ হলো ডিপ্রেশন। স্বাভাবিকভাবেই নিজের পরিচিত এলাকা থেকে এত দূরে আসার ফলে সবকিছু বদলে যায়। তার সাথে একাকীত্ববোধ আসে। নিজেকে হারিয়ে ফেলার মতো অনুভূতি হয়, দুর্বল বোধ হয়। উৎসাহে ভাটা পড়ে এবং নিজের পরিচয় নিয়ে সংকোচ বোধ হয়। এগুলো থেকে হতাশা বেশ ভালোভাবেই ধরে বসে।

অ্যাংজাইটি বা দুশ্চিন্তা 

নতুন একটা জায়গায় যাওয়ার পরে মানুষ প্রথমেই কিছুটা সংকোচ বোধ করে। এই সংকোচের মধ্যে নতুন নতুন জিনিস ট্রাই করা, এবং নতুন নতুন মানুষের সাথে পরিচিত হওয়াকে প্রথম প্রথম খুব বেশি মনে হতে পারে। এই সময়ে দুশ্চিন্তা জেঁকে বসে। প্রতিটা সিদ্ধান্ত নিয়ে দুশ্চিন্তা করা, বেশি বেশি ভাবা, মানুষ কী ভাববে, খারাপ হতে পারে, কেন নিজের পরিবেশ থেকে এত দূরে আসার সিদ্ধান্ত নেয়া হলো, এই ধরনের চিন্তা ভাবনা মাথায় চলে আসে।

নিজের দক্ষতা ও সামর্থ্যের উপর সন্দেহ 

মানুষ যখন নিজের স্বাভাবিক পরিবেশ ছেড়ে দূরে কোথাও চলে আসে, তখন তার সাথে খাপ খাইয়ে নেওয়া কঠিন হয়ে যায়। নিজের উপর ভরসা কমে যায়, তার ওপর ভর করে এরকম সিদ্ধান্ত নেয়া ঠিক হলো কিনা সে বিষয়ে সন্দেহ চলে আসে। আশেপাশের ভিন্ন পরিস্থিতির প্রভাবে এটা হওয়া খুব স্বাভাবিক।

নতুন দেশ ও তার পরিবেশের প্রতি নেতিবাচক অনুভূতি

স্বাভাবিকভাবেই, নতুন পরিবেশের সবকিছুই অন্যরকম হবে। খাবার, নিয়ম কানুন, মানুষজন সংস্কৃতি, রীতিনীতি ইত্যাদি সবকিছুই তার নিজের দেশ থেকে ভিন্ন হবে। এই ভিন্নতার কারণে প্রাথমিকভাবে মানিয়ে নিতে সমস্যা হতে পারে, এবং তা থেকে নেতিবাচক অনুভূতি, ভয়, ঘৃণা, বিরক্তি ইত্যাদি দেখা দিতে পারে।

কালচারাল শকের ফ্যাক্টর 

কালচারাল শক বেশ কিছু ফ্যাক্টর এর উপর নির্ভর করে একেক জনের উপর একেক রকম প্রভাব বিস্তার করে। সবার উপর এর প্রভাব সমান হয় না। ফ্যাক্টরগুলো নিয়ে আমরা আলোচনা করছি।

১. মানুষের নিজের সংস্কৃতি এবং নতুন দেশের সংস্কৃতির মধ্যে কতটুকু মিল অথবা ভিন্নতা রয়েছে এটি কালচারাল শকের ক্ষেত্রে বড় একটা ভূমিকা রাখে। হয়তো কিছু মিল পেয়ে মনে আনন্দ হতে পারে, অথবা তার মানসিক নিজস্বতায় আঘাত লাগতে পারে। এটা সম্পূর্ণই মানুষের দৃষ্টিভঙ্গির উপর নির্ভর করে। কখনো হয়তো আপনি নিজের সাথে অন্যের মিল দেখে খুশি হবেন, কখনো সেটাকে মনে করবেন আপনার অনন্যতায় আঘাত। নতুন দেশটির ক্ষেত্রেও ব্যাপারটা এভাবেই ঘটে।

২. ভিন্ন সংস্কৃতির মানুষের সাথে আগের অভিজ্ঞতাও এ ক্ষেত্রে বেশ ভালো প্রভাব ফেলে। যদি আপনার অন্য কোনো সংস্কৃতির মানুষের সাথে পরিচিত হওয়া এবং যোগাযোগের অভিজ্ঞতা থাকে, তাহলে সেই অভিজ্ঞতা ভালো ছিল নাকি খারাপ ছিল তার উপরে নির্ভর করবে আপনার পরবর্তী মনোভাব। যদি আপনার আগের অভিজ্ঞতা ভালো হয়, সে ক্ষেত্রে আপনার এক্সপেক্টেশন থাকবে বেশি, উত্তেজনা কাজ করবে। আর যদি অভিজ্ঞতা খারাপ হয় তাহলে আপনি নতুনভাবে কারো সাথে পরিচিত হতে নাও চাইতে পারেন। আগের অভিজ্ঞতা আপনার মনে কিছু হওয়ার আগেই নেতিবাচক চিন্তা ঢুকিয়ে দিতে পারে, তার ফলে নতুন জায়গার উৎসাহ উদ্দীপনা সরে গিয়ে সেখানে ভয় বা অস্বস্তির মতো অনুভুতি জায়গা করে নিতে পারে।

৩. ভাষাগত জ্ঞান এবং দক্ষতা ও এই ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। আপনি যে জায়গাটিতে যাচ্ছেন সেখানকার ভাষার উপর আপনার কতটুকু দখল রয়েছে, এটার উপরে নির্ভর করবে আপনি সেখানে গিয়ে মানুষের সাথে কেমন মিশতে পারছেন। যদি আপনার ভাষাগত দক্ষতা ভালো হয় তাহলে এ থেকে আপনার মধ্যে কনফিডেন্স আসবে, যেটা আপনাকে প্রাথমিক অস্বস্তি থেকে বাঁচাবে। আর যদি তা না হয় তাহলে অস্বস্তি কর অনুভূতিগুলো আরো বেড়ে যেতে পারে, নতুন নতুন মানুষের সাথে পরিচিত হওয়ার ইচ্ছা চলে যেতে পারে।

৪. নতুন এলাকা এবং নিজ এলাকার মধ্যে সাপোর্ট সিস্টেম এর পার্থক্য ও আপনার মনে বেশ ভাল রকমের প্রভাব ফেলবে। খুব স্বাভাবিকভাবেই আপনি নিজের এলাকায় যেভাবে কাজকর্ম করতে পারতেন, যে সামাজিক নিরাপত্তা পেতেন, এবং যেকোনো বিপদে যেমন ব্যাকআপ থাকতো, এই নতুন এলাকায় এসে সেগুলো থাকবে না। আপনাকে নতুন করে সবকিছু জেনে বুঝে নিতে হবে। আমাদের অভ্যাসের সাথে হঠাৎ করে এই নতুন নিয়মে আমরা নিজেদেরকে মানিয়ে নিতে পারি না। এর ফলে, কালচারাল শকের তীব্রতা বাড়তে পারে।

৫. বিভিন্ন চ্যালেঞ্জ এবং ডিফিকাল্টিজ এর সাথে আপনার নিজস্ব মানিয়ে নেওয়ার ক্ষমতাটাও কিন্তু এক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য। যদি আপনি উৎসাহী এবং ভোলা মনের হয়ে থাকেন সেই ক্ষেত্রে কালচারাল শক আপনাকে খুব বেশি কাবু করতে পারবে না। কিন্তু আপনি যদি নতুনত্বকে ভালোভাবে মেনে নিতে না পারেন, অথবা অস্বস্তি বোধ করেন সেক্ষেত্রে কালচারাল শক আপনাকে বেশি প্রভাবিত করতে পারে।

এই শক এর স্টেজগুলো কী কী?

কালচারাল শক মূলত চারটি স্টেজে হয়ে থাকে। এগুলো একের পর এক আসে, এবং এই স্টেজগুলোর মাধ্যমে মানুষ ধীরে ধীরে ভিন্ন একটা সংস্কৃতির সাথে নিজেকে মানিয়ে নেয়।

১. হানিমুন স্টেজ

কালচারাল শকের প্রথম স্টেজকে হানিমুন স্টেজ বলেই আখ্যায়িত করা হয়। এর কারণ নতুন একটা পরিবেশে আসতে মানুষ খুব উদগ্রীব থাকে, নতুন কিছু জানার উত্তেজনা তাদের মধ্যে কাজ করে। এবং চায় নতুন পরিবেশের সাথে যত দ্রুত সম্ভব নিজেকে মানিয়ে নিতে, মূলত এটাকে একটি অ্যাডভেঞ্চার হিসেবেই দেখা হয়। যদি কেউ অল্প সময়ের জন্য আসেন, তাহলে হয়তো তার পুরো সময়টাই এই হানিমুন স্টেজেই কেটে যায়। যে কারণে একই পরিবেশে থাকার অভিজ্ঞতা ভিন্ন ভিন্ন মানুষের ভিন্ন ভিন্ন রকম হতে পারে। ধীরে ধীরে নতুন জায়গা ঘুরে দেখা, নতুন খাবার টেস্ট করা, কোনো ধরনের সংস্কৃতির সাথে পরিচিত হওয়া এর সবকিছু নিয়েই প্রথম প্রথম খুব আনন্দ ও উৎসাহ কাজ করে। তবে একা লম্বা সময় থাকা হলে ধীরে ধীরে কেটে যেতে থাকে।

২. ডিসট্রেস স্টেজ

এই স্টেজে প্রথম প্রথম নতুন দেশে আসার মুগ্ধতাটা কেটে যেতে থাকে, এবং আস্তে আস্তে মানুষ চারপাশের পরিবেশ নিয়ে সচেতন হতে থাকে। নতুন সবকিছু তখন আর ভালো লাগে না, আস্তে আস্তে রীতিনীতি, চিন্তাধারা, ও মানসিকতার পরিবর্তনগুলো চোখে ধরা দিতে থাকে। এই সময় সাধারণত মানুষ হোম সিক ফিল করে, এবং নিজের সিদ্ধান্তকে দোষারোপ করতে পারে। নতুন পরিবেশে সম্পূর্ণভাবে মিলে যেতে না পারার কারণে এসময় একাকীত্ববোধ হয় এবং অসহায় লাগে। বর্তমান সংস্কৃতি, ভাষা, খাবার সবই যে নতুন, এবং চাইলেই পুরনো পরিবেশে ফিরে যাওয়া যায় না, এটা তখন মানুষের মনের মধ্যে জেঁকে বসে। লোকাল ভাষা ও রীতিনীতির সাথে পরিচিত না হওয়ায়, ভুল বোঝাবুঝি হতে পারে যে কারণে মানুষ নিজেকে আরও বেশি অসহায় মনে করে। বেশ কিছু সময়ে টাইম ডিস্টেন্সটাও বাধা হয়ে দাঁড়ায়। যদি অন্য সময় মানের দেশে চলে আসা হয়, সেক্ষেত্রে নিজ দেশের সাথে নতুন দেশের সময়ের ভিন্নতা ও মানুষকে বিরক্ত করে তোলে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, নতুন দেশে যখন আলো ঝলমলে দুপুর, আপনার মাতৃভূমিতে হয়তো তখন গভীর রাত, এ কারণে পরিবারের সাথে যোগাযোগ কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। যার ফলে আপনি আপনার অনুভূতিগুলো সহজে কারো সাথে শেয়ার করতে পারছেন না। তবে এই স্টেজও কেটে যায়। একটা সময় পরে, ধীরে ধীরে নিজেকে মানিয়ে নিতে নিতে, এই অস্বস্তি বোধ এবং হতাশাজনক অনুভূতিগুলো কেটে যায়। কালচারাল শকের নেতিবাচক অনুভূতিগুলো এই স্টেজেই বেশিরভাগ সময় দেখা যায়।

৩. এডাপ্টেশন স্টেজ

এডাপটেশন স্টেজটা হচ্ছে ধীরে ধীরে মানিয়ে নেওয়ার ধাপ। এই স্টেজে মানুষ আস্তে আস্তে নতুন সবকিছুতে অভ্যস্ত হতে শুরু করে, এবং সেভাবেই নিজেকে মানিয়ে নেয়। এ পর্যায়ে আমরা ধীরে ধীরে নতুন দেশের রীতিনীতিগুলোর গভীরে যাই, এবং তাদের বিভিন্ন সংস্কৃতি, সেগুলোর পিছনে ইতিহাস, সামাজিক প্রথা ও রীতিনীতি গুলোর কারণ এসব কিছু বুঝতে শিখি। ভালো লাগুক বা খারাপ, ভিন্ন পরিস্থিতিকে ধীরে ধীরে নিতে শিখি। তাদের নিজস্ব সংস্কৃতিকে সম্মান দিতে শিখি। আস্তে আস্তে নতুন পরিবেশ পুরনো হতে থাকে, এবং প্রাথমিক অস্বস্তি আর থাকে না। সে জায়গায় ধীরে ধীরে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করতে থাকি। নতুন যে কোনো সমস্যার সাথে মানিয়ে নেওয়া অথবা সমাধান করার নতুন উপায় ততদিনে আমাদের জানা হয়ে যায়। হয়তো অল্প কিছু নতুন বন্ধু বান্ধব জুটে যায়, যারা অস্বস্তিকর স্টেজটা কাটাতে সাহায্য করে।

৪. একসেপ্টেন্স স্টেজ

কালচারাল শকের ধাপ হল এক্সেপটেন্স স্টেজ। বা একে কালচারাল শকের ইতি ও বলা যায়। এই স্টেজে মানুষ তার পরিচয় তো দুটো সংস্কৃতিকেই ভালোভাবে বুঝতে শেখে। হয়তো ভাষাটা ভালোভাবে শেখা হয়ে যায়। নতুন পরিবেশটাকে মেনে নেওয়া হয়, এবং এর মধ্যকার নতুন নতুন জিনিসপত্র জানা হয়। এর সাথে তাল মিলিয়ে নিজের রুটিন এবং অভ্যাসও ঠিক করে নেওয়া হয়। নতুন পরিবেশকে তখন মনে হতে থাকে, সেখানে থাকতে আত্মবিশ্বাস আসে, এবং একে একটি অপরিচিত এবং অনিশ্চিত পরিবেশ আর মনে হয় না। এ পর্যায়ে হয়তো আপনার প্রতিবেশী, সহপাঠী, সহকর্মী ও আশেপাশের মানুষদের সাথে আপনার বেশ ভালো পরিচয় এবং খাতির হয়ে যাবে। হয়তো তাদের সংস্কৃতি তাদের থেকেই শিখে নেবেন ভালোভাবে। যেকোনো পরিস্থিতিতে নিজেকে আর অসহায় এবং একলা মনে হবে না। টাইম জোনের ডিফারেন্সগুলো, যেমন খাওয়ার সময়ের অভ্যাস, ঘুমানোর অভ্যাস ইত্যাদি আস্তে আস্তে নতুন এলাকার সাথে মানিয়ে যাবে। হয়তো আস্তে আস্তে নতুন জায়গাটিকে ভালবাসতেও শুরু করবেন!

এই শক কাটিয়ে ওঠার উপায় কী?

কালচারাল শক কাটিয়ে ওঠার বেশ অনেকগুলো উপায় আছে। তবে এক দুই দিনে চলে যাওয়ার মত ব্যাপার এটা নয়। স্বাভাবিকভাবেই প্রথম কিছুদিন সমস্যায় কাটতে পারে, তবে কিছু পদক্ষেপ নিলে, আস্তে আস্তে সবই সহনীয় হয়ে আসবে।

১. যে দেশ বা এলাকায় যাচ্ছেন তার সম্পর্কে ভালোভাবে রিসার্চ করে নিন। যত বেশি জানতে পারবেন, ততই আপনার লাভ। তাদের রীতিনীতি, আচার আচরণ, এলাকাভিত্তিক প্রথা এই সব কিছু সম্পর্কে ভালোভাবে জেনে নিলে ভালো হয়। আরো ভালো হয় যদি আগে থেকেই সেখানে পরিচিত কেউ থাকে। তার সাথে আলোচনা করে নিতে পারেন, তাহলে সরাসরি একটা ভালো ধারণা হবে।

২. আপনি যদি পড়াশোনার উদ্দেশ্যে যান, তাহলে খুব সহজেই একজন কাউন্সিলর পেয়ে যেতে পারেন। এ ব্যাপারে সবচেয়ে ভালো উপদেশ আপনাকে একজন প্রফেশনালই দিতে পারবেন, তাই কোনো কাউন্সিলরের সাথে কনসাল্ট করে নিন এবং আপনি যা যা ফেস করছেন তাকে বলুন। অনেক শিক্ষার্থী প্রায় নিয়মিতভাবেই কালচারাল শক ফেস করে থাকে, তাই নতুন পরিবেশে মানিয়ে নিতে কাউন্সিলর এর কাছ থেকে উপদেশ নিতে পারেন।

৩. কালচারাল শক সামলাতে প্রথমেই আপনাকে যে জিনিসটা এগিয়ে দেবে, সেটা হচ্ছে নতুন ভাষাটা শিখে রাখা। আপনার যদি কথাবার্তা বুঝতে কোনো অসুবিধা না হয়, তাহলে মানিয়ে নেয়াটা খুব সহজ হয়ে যাবে। তাই চেষ্টা করুন ভাষাটা আগে থেকেই শিখে নেওয়ার, একদম যে দক্ষ হতে হবে তা নয়, কথাবার্তা চালানোর মতো হলেই আপনি অনেকটা এগিয়ে যাবেন।

৪. আশেপাশে বন্ধুবান্ধব বানিয়ে নিন। আশেপাশের মানুষদের সাথে পরিচিত হতে পারলে, নতুন পরিবেশে মানিয়ে নেয়াটা আপনার জন্য সহজ হয়ে যাবে। যে কোনো গাইডবুক, ট্রাভেল ফোরাম, অথবা ইন্টারনেটের অন্যান্য উৎসের চাইতে একজন স্থানীয় মানুষ আপনাকে অনেক ভালো তথ্য দিতে পারবেন। তাই সেখানকার স্থানীয় মানুষদের সাথে সম্পর্ক গড়ে তুলুন। সহপাঠী, সহকর্মী, প্রতিবেশী এবং প্রতিদিন দেখা হয় এমন কারো সাথে ধীরে ধীরে বন্ধুত্ব গড়ে তোলার মাধ্যমে আপনি তাদের সম্পর্কে জানতে পারেন।

৫. আপনার সবকিছুতে আপনার পরিবার ও বন্ধুবান্ধব যেরকম সাপোর্ট দেন তেমনটি আর কেউ দিতে পারবেন না, নতুন একটি দেশে তো না ই। তাই নিয়মিত সময় করে বাসায় যোগাযোগ রাখবেন, বন্ধুবান্ধবের সাথে কথা বলবেন। টেকনোলজির যুগে, বর্তমানে সারা বিশ্বের সাথে যোগাযোগ রাখা খুব সহজ হয়ে গেছে। খুব বেশি না হোক দিনে অন্তত ১০-১৫ মিনিট ফেস টু ফেস ভিডিও কল, আপনার মনকে যে কতটা ভালো করে দেবে, তা আপনি নিজেই বুঝতে পারবেন। এমন বেশ অনেকবারই হতে পারে, যে খারাপ সময় যাচ্ছে, অস্বস্তি বোধ হচ্ছে, অথবা মানিয়ে নিতে পারছেন না। এমন সময়ে  পরিবারের সাথে যোগাযোগ করলে, অথবা খুব কাছের বন্ধুদের সাথে কিছুক্ষণ মন খুলে কথা বললে দেখবেন অস্বস্তিবোধ কেটে গেছে। তাই পরিবারের সাথে নিয়মিত যোগাযোগ রাখাও আপনার মনের নেতিবাচক অনুভূতিগুলো কমাতে সাহায্য করবে।

৬. মন খোলা রাখতে হবে। নতুন দেশের অনেক কিছুই হয়তো আপনার ভাবনা চিন্তার সাথে, অথবা পরিচিত পরিবেশের সাথে মিলবে না। কিন্তু সেগুলো আপনাকে খোলা মনে গ্রহণ করতে হবে। সব সময় নিজের পরিচিত পরিবেশের সাথে তুলনা করা আপনার মনকে আরও খারাপ করে দিবে। তাই ভিন্নতা মেনে নিয়ে খোলা মনে নতুন সংস্কৃতির সাথে পরিচিত হতে হবে।

৭. বন্ধু বান্ধবের কাছে তাদের সংস্কৃতি সম্পর্কে জানতে চাওয়ার সাথে সাথে আপনার নিজস্ব সংস্কৃতি ও শেয়ার করুন। তাদের সাথে আপনাদের সংস্কৃতি কীভাবে ভিন্ন, কী কী মিল রয়েছে, কোন কোন ব্যাপারগুলো আপনাকে আকৃষ্ট করেছে, কোন বিষয়গুলো আপনার ভালো লাগছে, এসব শেয়ার করতে পারেন। নিজের সংস্কৃতির মজার ব্যাপারগুলোও তাদেরকে বলতে পারেন। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, পশ্চিমাদের নিউ ইয়ার উদযাপন আর আমাদের নববর্ষ উদযাপন খুবই ভিন্ন। দুটোই নতুন বছরকে স্বাগত জানানোর জন্য হলেও দুই দেশের মানুষ আলাদা আলাদা ভাবে সেগুলো উদযাপন করে। আপনার দেশের বিশেষ দিনে বিশেষ কিছু করে বন্ধুবান্ধবদের আপনার সংস্কৃতি সম্পর্কে জানাতে পারেন। কমিউনিকেশন দুই দিক থেকেই হতে হয়, কখনো একপাক্ষিক হয় না।

৮. পার্সোনাল ডায়েরি অথবা জার্নাল আমাদের আবেগ অনুভূতিগুলোকে ধরে রাখার জন্য, এবং মন হালকা করার জন্য খুব ভালো একটি মাধ্যম হতে পারে। প্রতিদিনকার অনুভূতি, নতুন নতুন যা যা ফেস করছেন, শিখছেন, আপনার সাথে যেগুলো যেগুলো হচ্ছে এই সবকিছু সম্পর্কে লিখে রাখতে পারেন একটি জার্নাল অথবা পার্সোনাল ডায়েরিতে। হতে পারে, অবসর সময়ে নিজের লেখা পড়লে অন্য একটি দৃষ্টিভঙ্গি থেকে আপনি ব্যাপারগুলো বুঝতে পারবেন। আপনার সাথে কী কী হলো, কোনটা আপনার ভালো লেগেছে, কোনটা খারাপ লেগেছে, কোনটায় আপনার আগের অভিজ্ঞতার সাথে মিল আছে, অথবা কোনটা একেবারেই নতুন এই সবকিছুই আপনি লিখতে পারেন আপনার পার্সোনাল ডায়েরিতে। অন্তত একাকিত্বের সময়ে আপনাকে সময় কাটাতে সাহায্য করবে।

৯. নতুন একটা পরিবেশে অনেক কিছুই শেখার থাকে। আপনি তাদের রান্না এবং রেসিপিগুলোতে ফোকাস করতে পারেন। বলা হয়ে থাকে একটি জাতির বিশেষত্ব তাদের খাওয়া দাওয়ায় নির্ভর করে। একেক এলাকার মানুষজন একই ইনগ্রেডিয়েন্ট দিয়ে ভিন্ন ভিন্ন ভাবে রান্না করে থাকে। নিজ এলাকার খাবারের সাথে সাথে নতুন এলাকার খাবার ও রান্না করে দেখতে পারেন। এতে বাইরের খাবার খেতে হবে না, শরীর ভালো থাকবে, খরচ কমবে এবং আপনি নতুন অনেক কিছু জানতে পারবেন। হতে পারে এই রান্নার সূত্রেই আরো নতুন নতুন বন্ধুবান্ধব হয়ে গেল আপনার!

এমন শক কি ভালো না খারাপ?

কালচারাল শককে নির্দিষ্টভাবে ভালো অথবা খারাপের তালিকায় ফেলা যায় না। প্রাথমিকভাবে ধরনের অভিজ্ঞতা সবারই খারাপ লাগে, প্রথম ধাক্কাটা নেতিবাচকই মনে হয়। তবে এটা দেশ অথবা পরিবেশ বদলের ক্ষেত্রে খুবই স্বাভাবিক। পরিচিত পরিবেশ ছেড়ে এসে সম্পূর্ণ নতুন পরিবেশে মানিয়ে নেওয়াটা অত সহজ নয়। তবে একটু কঠিন হলেও, মন খোলা রেখে যারা নতুন সংস্কৃতিকে গ্রহণ করতে পারেন তারাই খুব দ্রুত কালচারাল শক কাটিয়ে উঠতে পারেন। আপনি যত ওপেন মাইন্ডেড হবেন আপনাকে তত কম এফেক্ট করবে। যেহেতু আপনাকে একটা লম্বা সময় নতুন পরিবেশে কাটাতে হবে তাই এটাকে ধীরে ধীরে মেনে নেওয়াই ভালো। এভাবে ভাবতে গেলে বলা যায় কালচারাল শক আমাদের নতুন ধরণের নিজস্বতার অনুভূতি দিতে পারে, এবং দিনশেষে হয়তো এটা একটা ভালো অভিজ্ঞতাতেই পরিণত হতে পারে। তাই নেগেটিভভাবে না নিয়ে যত দ্রুত কালচারাল শোকে এডজাস্ট করে নেয়া যায়, ততই মানিয়ে নিতে সুবিধা হয়।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *