সাদা-নীলের ফেসবুক | মজাচ্ছলে তৈরী করা বিশ্বসেরা সামাজিক প্ল্যাটফর্ম

বর্তমান দুনিয়ায় ফেসবুক চেনেন না বা জানেন না এমন মানুষ বোধহয় খুঁজে পাওয়া একটু কঠিনই হবে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোর একবারে শুরুর দিকে তৈরী হওয়া এই সামাজিক মিডিয়া প্ল্যাটফর্মটি বর্তমানে সারাবিশ্বের কাছে এক প্রয়োজনীয় দৈনন্দিন জিনিস হয়ে দাঁড়িয়েছে। হোক দেশের প্রধানমন্ত্রী অথবা কোনো সিনেমার নায়ক, বিশ্বসেরা খেলোয়াড় অথবা নিতান্তই কোনো সাধারণ মানুষ- সকলেই ফেসবুক ব্যবহার করে থাকেন। মুহুর্তেই বিশ্বের এক মাথার খবর চলে যাচ্ছে অন্য মাথায়, চাইলেই লাখো মানুষের কাছে পৌঁছে যাচ্ছে আপনার মতামত- এ যেন এক জাদুর কারখানা। আজকে সেই বহুল পরিচিত যাদুর কারখানার শুরুর কথাই জানাতে এসেছি আপনাদের। চলুন জেনে নিই ফেসবুকের আদ্যোপান্ত।

বুদ্ধিদীপ্ত তরুণের দুর্দান্ত আবিষ্কার

হোয়াইট প্লেইন্স, নিউ ইয়র্কে সাইক্রিয়াটিস্ট ক্যারেন এবং ডেন্টিস্ট এডওয়ার্ড জাকারবার্গের ঘরে ১৪ ই মে, ১৯৮৪ সালে জন্মগ্রহণ করেন মার্ক এলিয়ট জাকারবার্গ। তিন বোনের একটি মাত্র ভাই ছোট থেকেই ছিলেন বেশ বুদ্ধিদীপ্ত। আর্ডসলে হাই স্কুলে প্রাথমিকভাবে ভর্তি হলেও পরবর্তীতে তিনি ফিলিপ্স এক্সেটার একাডেমিতে ট্রান্সফার হন। ছোটকাল থেকেই কম্পিউটার সফটওয়্যার এর প্রতি এক দারুণ আকর্ষণ ছিলো মার্কের। মিডল স্কুলে থাকতেই কম্পিউটার ব্যবহার করে তিনি একটি লেখার সফটওয়্যার তৈরী করেন। হাই স্কুলে উঠে তিনি “জুকনেট” (Zuknet) নামের একটি সফটওয়্যার তৈরী করেন যার মাধ্যমে তার বাবার ডেন্টাল অফিস ও তাদের বাসার সমস্ত কম্পিউটার একটির সাথে আরেকটি কানেক্ট করা যেত এবং যোগাযোগ করা যেত। হাই স্কুলে থাকতেই তিনি “সিনাপ্স মিডিয়া প্লেয়ার” নামের একটি মিডিয়া প্লেয়ার তৈরী করেন যেটি তার ব্যবহারকারিদের গান শোনার অভ্যাস ট্র্যাক করে শিখতে পারতো। এই মিডিয়া প্লেয়ারটি সে সময়ের জনপ্রিয় ওয়য়েবসাইট স্লাশডট এ পাবলিশ করা হয় এবং এটি ৫ স্কোরের মধ্যে ৩ পায়। সে সময় জনপ্রিয় ম্যাগাজিন “দ্যা নিউ ইয়র্কার” এ মার্ক জুকারবার্গ সম্পর্কে সে সময়ে বলেছিলো, “কিছু বাচ্চা কম্পিউটার গেম খেলছিলো ,সেগুলো তৈরী করেছিলো মার্ক।“ হাই স্কুলে থাকতেই মার্সি কলেজে কম্পিউটারের উপর স্নাতক কোর্স করেন।

দ্যা নিউ ইয়র্কারের মতে, বিশ্ব বিখ্যাত হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে ২০০২ সালে স্নাতকের ক্লাস শুরু করার আগে থেকেই মার্ককে “প্রোগ্রামিং প্রোডিজি” (প্রোডজি- যে তার বয়স বা সময় অনুযায়ী কোনো একটি  বা একাধিক বিষয়ে অত্যাধিক পারদর্শী হয়ে থাকে।) বলে মানুষজন চিনতে শুরু করেছিল। তিনি সাইকোলজি ও কম্পিউটার সায়েন্স নিয়ে পড়াশোনা করতে শুরু করেন। কার্কল্যান্ড হাউজে থাকা কিছুটা ইন্ট্রোভার্ট, প্রোগ্যামিং পাগল এই তরুণ কিন্তু সবার পরিচিত মুখ ছিলেন। এর পেছনে আরো বড় একটা কারণ ছিল, দ্বিতীয় বর্ষে পড়াকালীন “কোর্স ম্যাচ” নামের একটি প্রোগ্রাম তৈরী করেন যা শুধুমাত্র হার্ভার্ডের ছাত্রছাত্রীরাই ব্যবহার করতে পারতো। এই প্রোগ্রামটির মূল কাজ ছিলো কোন শিক্ষার্থী কোন কোর্স নিয়েছেন তা জানানো। কোর্স অথবা শিক্ষার্থী প্রোফাইলে ঢুকলেই জানা যেত কে কোন কোর্সে আছেন- ফলে কেউ যদি তার বন্ধুদের সাথে একই গ্রুপে কোর্স করতে চাইতো তার জন্য এটি জানা বেশ সহজ হতো। এই প্রোগ্রামটি মার্ককে জনপ্রিয়তার শীর্ষে নিয়ে যায়। শত শত শিক্ষার্থী এটি ব্যবহার করত। বলা যায় ফেসবুকের ভিত্তি প্রোগ্রাম ছিলো এটি। যদিও প্রোগ্রামটি বানানো মার্কের জন্য এমন কঠিন কিছু ছিলো না তবে এ থেকেই বোঝা যায় যে মার্ক মানুষের চাহিদা বুঝতো এবং জনপ্রিয় আইডিয়া বের করায় পারদর্শী ছিলো।

দুষ্টুমির আইডিয়া থেকে প্রায় ড্রপ আউট

অনেক বুদ্ধিমান মানুষদের দুষ্টুমীও বেশ মজার এবং বুদ্ধিদীপ্ত হয়ে থাকে তা সন্দেহ নেই। সে সময় সময়টা বেশি ভালো যাচ্ছিলো না মার্কের। এক বান্ধবীর সাথে সম্পর্ক শেষ হয়ে যাওয়ায় বেশ রাগ, ক্ষোভ ও মন খারাপ নিয়ে ঠিকমতো কাজ করতে পারছিলেন না। তখনই মাথায় এক দুষ্টু বুদ্ধি চাপলো মার্কের। সময়টা ছিলো অক্টোবর ২৮, ২০০৩, মার্ক তৈরী করলেন একটি প্রোগ্রাম যার নাম ছিলো “ফেসম্যাশ” (Facemash)। বান্ধবীর সাথে সম্পর্ক নিয়ে সেই বাজে সিচুয়েশন থেকে নিজের মনোযোগ সরাতেই এটি নিয়ে কাজ করছিলেন। প্রথমে তিনি ঠিক করলেন এমন একটি প্রোগ্রাম বানাবেন যেটি দিয়ে মানুষের সাথে পশুর তুলনা করা যাবে। কিন্তু রুমমেট বিলি ওলসন তাকে বললেন, পশু নয় বরং মানুষের সাথে মানুষের তুলনা করা হোক। আট ঘন্টা পরিশ্রম করে ফেসম্যাশ প্রোগ্রামটি তৈরী করলেন মার্ক। প্রোগ্রামটির মূল উদ্দেশ্য ছিলো হার্ভার্ডের সবচেয়ে আকর্ষণীয় ছেলে এবং মেয়ে খুঁজে বের করা। এই প্রোগ্রামে দুজন মানুষের ছবি দিয়ে “হট” অর “নট” ভোট দিয়ে তাদের আকর্ষণীয়তা রেট করা যেত। এভাবে একজন যখন জিতে যেতো তখন তার সাথে আরেকজন বিজেতার ছবি দিয়ে তুলনা করা যেত। বলাই বাহুল্য, হার্ভার্ডের ছেলেমেয়েদের মাঝে এই ওয়েবসাইটটি ছড়িয়ে পড়তে মোটেই সময় লাগেনি। দ্রুতই তারা এই অসুস্থ বিনোদনকে খুব উপভোগ করতে থাকলো। আর কর্তৃপক্ষের নজর কাড়তেও সময় লাগলো না। মূলত এই প্রোগ্র্যামে মার্ক যে সকল ছবি ব্যবহার করেছিলেন তা ছিলো হার্ভার্ডের বিভিন্ন হাউজের ওয়রিয়েন্টেশনের দিন তোলা শিক্ষার্থীদের ছবি। মার্ক এগুলো নানা বেআইনি পন্থায় হাউজগুলোর ওয়েবসাইট হ্যাক করে “ফেসবুক” এর ডিজিটাল সংস্করন তৈরী করেছিলেন। হার্ভার্ডের নানা আইন কানুন ভঙ্গ তো করেছিলেনই, সাথে ফেসম্যাশ এর মাধ্যমে রেসিজম ছড়িয়ে পড়ার অভিযোগ আসতে থাকে সক্রিয় সব সামাজিক সংগঠন থেকে। ফলে মার্কের ইন্টারনেট ব্যবহার ও ফেসম্যাশ বন্ধ করে দেয়া হয়। বন্ধ করার আগে ফেসম্যাশ মাত্র দুইদিনে এটি প্রায় ৪৫০ শিক্ষার্থী ব্যবহার করেন এবং ২২,০০০ ভোট দেন। সে যাত্রায় মার্ক কে হার্ভার্ড থেকে বহিষ্কার করা হয় না, একজন কাউন্সিলরের তত্ত্বাবধায়নে কিছুদিন থাকার নির্দেশ দিয়ে ছেড়ে দেয়া হয়। সেই সিন্যাপ্স মিডিয়া প্লেয়ার থেকে কোর্স ম্যাচ, ফেসম্যাশ- এগুলোকে বলা যায় ফেসবুকের ভিত্তি প্রোগ্রাম। কারণ ফেসবুক হলো মার্কের এ সমস্ত প্রোগ্রামের এক মহা সম্মেলন।

দুনিয়া বদলে দেয়া ফেসবুক

ফেসম্যাশের ঘটনাতে মার্ক বুঝে গিয়েছিলেন যে এ ধরনের প্লাটফর্ম ছাত্র ছাত্রীদের মাঝে তুমুল জনপ্রিয় হবে। “ফেসবুক” ছিলো মূলত হার্ভার্ডের সকল হাউজের ছাত্র ছাত্রীদের ছবির তালিকা। অনেকদিন ধরেই ছাত্র ছাত্রীরা এর একটি অনলাইন সংস্করন তৈরী করার দাবী জানিয়ে যাচ্ছিলো যেন তারা সহজেই সকলের প্রোফাইল ঘুরে দেখতে পারে। হার্ভার্ড কর্তৃপক্ষ বার বার আশ্বাস দিয়েও তা পূরণ করছিলো না। ততদিনে ফ্রেন্ডস্টার, মাইস্পেস এর মতো যোগাযোগ মাধ্যম ইন্টারনেট দুনিয়ায় তুমুল জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে, কাজেই এটি যে কঠিন কিছু না তা শিক্ষার্থীরা জানতো।

মার্ক চিন্তা করলেন এই সুযোগ ছাড়া ঠিক হবেনা। তাছাড়া হার্ভার্ড কর্তৃপক্ষকে এক হাত দেখে নেয়ারও একটা বেশ সুযোগ পাওয়া গেলো। কাজেই তিনি “ফেসবুক” তৈরীর কাজে লেগে পড়লেন। ২০০৪ সালের জানুয়ারি মাসে সে “ফেসবুক” এর জন্য কোডিং করা শুরু করে। তার বন্ধু বান্ধবেরা খুব একটা পাত্তা দেয় না কারণ মার্ক সবসময়ই এরকম কোন না কোন প্রোগ্রাম তৈরী করতেই থাকে। ২০০৪ সালের ১১ জানুয়ারি “the Facebook.com” নামের ওয়েবসাইট এক বছরের জন্য কিনে নেন মার্ক।

মার্ক ফ্রেন্ডস্টার সোশ্যাল সাইটটি ব্যবহার করতেন। সেখান থেকে কিছু আইডিয়া ধার করারও চিন্তা করলেন। ফ্রেন্ডস্টার ছিলো একটি ডেটিং অ্যাপ, যেটিতে ব্যবহারকারীরা মিউচুয়াল ফ্রেন্ডদের মাঝে থেকে সঙ্গী খুঁজে নিতে পারতেন। শিক্ষার্থীদের দাবী ছিলো যে “সান ফ্রান্সিসকোর একজন ব্যক্তি যদি ফ্রেন্ডস্টারের মতো প্রোগ্রাম বানিয়ে ফেলতে পারে তাহলে হার্ভার্ড কেন পারবে না!” এটির প্রতি উত্তরে হার্ভার্ড এর পত্রিকা “ক্রিমসন” এ একটি আর্টিকেলের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদেরকে ফেসবুকের অনলাইন ভার্সন বানানোর জন্য দিক নির্দেশনা দেয় ও তাদেরকে বিশেষ করে নিজেদের ছবি ও সঠিক তথ্য দেয়ার জন্য নির্দেশ দেয়। ক্রিমসনের এই আর্টিকেল মার্ককে বেশ সাহায্য করে। সেসময় ফ্রেন্ডস্টার ছাড়াও আরো একটি ম্যাসেজিং সার্ভিস AIM জনপ্রিয় ছিলো, সে অ্যাপটিতে কেউ অনলাইনে না থাকলে তার জন্য কয়েক লাইনের ছোট ম্যাসেজ দেয়া যেত। এটি থেকে মার্ক স্টাটাস আপডেট করার আইডিয়া পেয়ে যান। ছাত্রছাত্রীদের নিজেদের প্রোফাইল তৈরী করা ও ফ্রেন্ডস্টারের মত একের সাথে অন্যের যুক্ত হওয়া এসকল আইডিয়া মিলে ফেব্রুয়ারি ৪, ২০০৪ সালে “The Facebook” চালু করেন মার্ক। ম্যানেজ ডট কম এর লিংকে ক্লিক করতেই জীবন্ত হয়ে ওঠে দ্যা ফেসবুক। এর চার নম্বর ব্যবহারকারী হিসেবে রেজিস্ট্রেশন করেন তিনি। প্রথম তিনটি একাউন্ট ছিলো পরীক্ষামূলকভাবে তৈরী করা। পঞ্চমে তার রুমমেট হিউজেস, ৬ষ্ঠ তে তার স্যুট-মেট মস্কোভিচ ও ৭ম ব্যবহারকারী হিসেবে স্যাভেরিনকে নিয়ে যাত্রা শুরু হয়ে এই অসাধারণ ওয়েবসাইটটির। প্রাথমিকভাবে শুধুমাত্র হার্ভার্ড এর শিক্ষার্থীরাই এটি ব্যবহার করতে পারতেন।

চালু হওয়ার পর চারদিনে প্রায় ৬৫০ জন দ্যা ফেসবুকে সাইন আপ করে। যেহেতু ফেসবুকের প্রাথমিক উদ্দেশ্য ছিলো ছাত্রছাত্রীদের মাঝে যোগাযোগ ও তাদের শিক্ষায়তনের নানা তথ্যাদি শেয়ার করা, তাই এটি কোনো ডেটিং অ্যাপ এর মত কাজ করতো না। বরং এটি সাধারণ যোগাযোগের একটি চমৎকার মাধ্যম হয়ে ওঠে নতুন সব ফিচার নিয়ে। কাজেই খুব দ্রুত এটি জনপ্রিয়তা পেতে থাকে। সাধারণত মার্কের তৈরী করা সব প্রোগ্রামই তার কম্পিউটার থেকে হোস্ট করা হতো হার্ভার্ড এর ইন্টারনেট ব্যবহার করে। কিন্তু দ্যা ফেসবুক মার্ক হার্ভার্ড এর বাইরে রাখতে চেয়েছিলেন তাই এটি হোস্ট করার জন্য Manage.com নামের একটি হোস্টিং কোম্পানির কাছ থেকে মাসিক ৮৫ ডলারের বিনিময়ে কম্পিউটার সার্ভারের সুবিধা নেন। ফেসবুকের প্রথম লোগোটি ডিজাইন করেন মার্কের বন্ধু এন্ড্রু ম্যাকক্যালাম। ইন্টারনেট থেকে অভিনেতা আল পাচিনোর ছবি নিয়ে সেটিকে বাইনারির প্রধান সংখ্যা ১ এবং জিরো দিয়ে ঢেকে দিয়ে লোগোটি তৈরী করেন।

ফেসবুক

 

খুব শ্রীঘ্রই হার্ভার্ডের ডাইনিং থেকে হলরুম- সবখানে আলোচনার শীর্ষে চলে আসে মার্কের দ্যা ফেসবুক। কেউ যেন এটি ব্যবহার করা থেকে নিজেদেরকে বিরত রাখতেই পারছিলো না। এক সপ্তাহ পার হতে না হতেই হার্ভার্ডের প্রায় অর্ধেক শিক্ষার্থী ফেসবুক ব্যবহার শুরু করেন, সাথে যুক্ত হয় অনেক প্রাক্তন ছাত্র ও কর্মকর্তারাও। সেসময় ফেসবুকে নিজের প্রোফাইল ছবি সহ পছন্দের সিনেমা, রিলেশনশীপ স্টাটাস, প্রিয় বই ইত্যাদি নানারকম তথ্য যোগ করা যেত। এমন কি কে কোন কোর্স নিচ্ছে সেটিও দেখা যেত। কেউ কেউ শুধুই মজার জন্য, কেউ কেউ সময় কাটানোর জন্য আবার কেউ কেউ কাজের বিভিন্ন কাজে ফেসবুক ব্যবহার করতে শুরু করলো। শুরু থেকেই প্রাইভেসীর ব্যাপারে মার্ক কোন ছাড় দিতে রাজি হননি। একাউন্ট খুলতে বাধ্যতামূলকভাবে Harvard.edu ই-মেইল টি ব্যবহার করতে হতো। এছাড়া আসল নামেও একাউন্ট খুলতে হতো যা সেসময়ে ছদ্মনামের ইন্টারনেট দুনিয়ায় ফেসবুক কে আলাদা করে তোলে। এমন কি ব্যবহারকারীর বিভিন্ন তথ্য কারা দেখতে পারবে, সেই প্রাইভেসিও কন্ট্রোল করা যেত, তাই এটির ব্যবহারকারী আরো বাড়তে থাকে। তিন সপ্তাহের মাথায় ফেসবুকের ব্যবহারকারী ছয় হাজারে পৌঁছে যায়।

কিছুদিন যেতেই মার্ক বুঝতে পারেন ফেসবুকের এই তুমুল চাহিদা ও জনপ্রিয়তা তার একার পক্ষে আর সামলানো সম্ভব নয়। এগিয়ে আসেন তার বন্ধু মাস্কোভিস। অর্থনীতির ছাত্র হয়েও দিনরাত পরিশ্রম করে শেখেন প্রোগ্রামিং। অবশেষে বন্ধুদের নিয়ে ফেসবুক এ নতুন চুক্তি গঠন করা হয় যেখানে ফেসবুকের ৬৫% মালিকানা মার্কের, ৩০% মালিকানা স্যাভেরিনের এবং ৫% মালিকানা মস্কোভিসের ছিলো। মস্কোভিসের মূল কাজ ছিলো অন্য ক্যাম্পাসে ফেসবুক সম্প্রসারণ করা। ফেসবুক শুরুর দ্বিতীয় সপ্তাহ থেকেই বিভিন্ন ক্যাম্পাস থেকে আবেদন আসতে শুরু করে ফেসবুক ব্যবহারের আওতায় আনার জন্য। মার্কও চেয়েছিলেন তার ফেসবুক হার্ভার্ডের গন্ডি পেরিয়ে ছড়িয়ে পড়ুক। মস্কোভিস নতুন কোন ইউনিভার্সিটি বা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান যুক্ত করার জন্য সেই ভার্সিটির ইমেইল এড্রেস, কোর্সের তালিকা এসব সংগ্রহ করে সেই অনুযায়ী ফেসবুকের কোড পরিবর্তিন করতেন যেন ক্যাম্পাসগুলো ফেসবুকে যুক্ত হতে পারে। ফেব্রুয়ারি ২৫, ২০০৪ এ কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়, ২৬ তারিখ স্টানফোর্ড ইউনিভার্সিটি এবং ২৯ তারিখ ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয়ও ফেসবুকে যুক্ত হয়। আস্তে আস্তে ফেসবুক এত জনপ্রিয় হয়ে ওঠে যে মার্কের সাক্ষাৎকার নিতে প্রচুর সাংবাদিক আসতে থাকে। এতে বিরক্ত হয়ে সাক্ষাৎকার দেয়ার জন্য রুমমেট ক্রিস হিউজেস কে নিয়োগ দেন। সে সময় ফেসবুকের মাসিক খরচ ছিলো মাত্র ৮৫ ডলার। যদিও শুরুতে এটিকে বাণিজ্যিকভাবে তখনো শুরু করার ইচ্ছা ছিলো না তবে কিছুদিন পরই মার্ক এর উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ বুঝতে পারেন। তাই হার্ভার্ডের এত দারুণ জায়গা ড্রপ আউট করেন এবং ফেসবুকের কোম্পানি হার্ভার্ড থেকে পালো অল্টো, ক্যালিফর্নিয়াতে শিফট করেন। এ সময় ফেসবুক কেনার জন্য অনেকে অফার করলেও মার্ক রাজি হননি। বরং তিনি পিটার থিয়েল (পেপ্যালের প্রতিষ্ঠাতা) এর কাছ থেকে ৫ লাখ ডলার ইনভেস্ট নেন। ২০০৪ এর শেষের দিকে ফেসবুকের ব্যবহারকারী এক মিলিয়ন ছাড়িয়ে যায়।

২০০৫ সালে “দ্যা ফেসবুক” থেকে নামটি শুধুই “ফেসবুক” ডট কম করা হয়, এবং এই ডোমেইনটি দুই লাখ ডলারের বিনিময়ে কিনে নেয় ফেসবুক কোম্পানি। সেপ্টেম্বর ২৬, ২০০৬ সালে ফেসবুক সকলের জন্য উন্মুক্ত করে দেয়া হয়। একটি ভ্যালিড ই-মেইল এড্রেস ও বয়স ১৩ বছরের উপর হলেই ফেসবুক ব্যবহারের জন্য রেজিস্ট্রেশন করা যেত। ততদিনে ফেসবুক কোম্পানিতে একটি ভেঞ্চার ক্যাপিটাল ফার্ম এক্সেল ফেসবুকে ১২.৭ মিলিয়ন ডলার ইনভেস্ট করে। ফেসবুক উন্মুক্ত হওয়ার পর থেকেই পুরো বিশ্বেই চোখের পলকেই যেন ছড়িয়ে পড়ে। ডিসেম্বর ২০০৬ এ এর ব্যবহারকারি ছিলো ১২ মিলিয়ন। সেখান থেকে মাত্র ৪ মাসে, এপ্সিল ২০০৭ এ ব্যবহারকারি হয় ২০ মিলিয়ন। ২০০৭ সালে ফেসবুক আনে আরো একটি দারুন ফিচার, ফেসবুক মার্কেটপ্লেস। ফলে নানা ধরনের বিক্রেতারাও খুব সহজে ফেসবুক কে বেচাকেনার জন্য ব্যবহার করতে শুরু করে। ২০০৭ এর শেষের দিকে প্রায় ১ লাখ বিক্রেতা ফেসবুকে তাদের কোম্পানি নিয়ে সাইন আপ করে। ২০০৭ সাল থেকে বাংলাদেশেও ফেসবুক ব্যবহার শুরু হয়, এবং সেই বছরেই প্রায় ৩০ লাখ বাংলাদেশী ব্যবহারকারী ফেসবুকে যুক্ত হন।

 

বিতর্ক ও অভিযোগ

প্রতিটি সাফল্যের পেছনেও থাকে একটি অন্ধকার অংশ। বাঁধা বিপত্তি ছাড়া কোনোকিছুই অনন্য উচ্চতায় উঠতে পারে না। এছাড়া চলার পথে যেকোনো প্রতিষ্ঠান নিতে পারে ভুল কোনো পদক্ষেপ যা তৈরী করতে পারে প্রতিষ্ঠানটির জন্য বিরূপ মনোভাব। ফেসবুকও এর ব্যতিক্রম ছিল না।

শুরুর ছয় দিনের মাথায়ই হার্ভার্ড এর তিনজন সিনিয়র মার্কের বিরুদ্ধে অভিযোগ করেন যে মার্ক তাদেরকে বিভ্রান্ত করে HarvardConnection.com নামের একটি সামাজিক নেটওয়ার্ক তৈরীর কথা বলে তাদের আইডিয়া দিয়ে ফেসবুক চালু করেছেন। তারা এটি হার্ভার্ডের ক্রিমসন পত্রিকার কাছে বলেন, মার্ক পত্রিকার সম্পাদককে এটি প্রকাশ না করতে অনুরোধ করেন। তবে তিনি না শুনলে পত্রিকার সম্পাদকদের ইমেইল এড্রেস হ্যাক করেন ফেসবুকের লগ ইন এর তথ্য দিয়ে। ফলে কোর্টে কেস হয়ে যায়। যা পরবর্তীতে ফেসবুকের কিছু শেয়ার ও ২০ মিলিয়ন নগদ ডলারের মাধ্যমে নিষ্পত্তি করা হয়।

২০০৫ সালে ফেসবুকের সহ-প্রতিষ্ঠাতা এর্ডুয়ার্ডো স্যাভেরিন অভিযোগ করেন যে মার্ক স্যাভেরিনের প্রফিটের অংশের টাকা ব্যক্তিগত কাজে খরচ করছেন। এ নিয়ে মামলা ও নিষ্পত্তি হয় যদিও তার বিস্তারিত জানায় যায়নি। স্যাভেরিন এটি নিয়ে আর কখনোই কোনো কথা বলেননি।

তবে ফেসবুকের সবচেয়ে বড় কন্ট্রোভার্সির ঘটনা জানা যায় ২০১৮ সালে। যেখানে বলা হয় ২০১০ সাল থেকে ফেসবুক বিভিন্ন ব্যবহারকারীর ব্যক্তিগত তথ্য ব্রিটিশ কনসাল্টিং ফার্ম “ক্যাম্ব্রিজ অ্যানালেটিকা” কে ব্যবহারকারীর অজান্তেই পাচার করে আসছে মূলত রাজনৈতিক প্রচারণাতে সাহায্য করার জন্য। এতে পুরো বিশ্বে তোলপাড় শুরু হয়ে যায় কারণ ততদিনে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি থেকে সাধারণ মানুষ সকলেই ফেসবুক প্রাত্যাহিক জীবনে হরদম ব্যবহার করছেন। শেয়ার করছেন গুরুত্বপূর্ণ ও ব্যক্তিগত তথ্য, ছবি বা ভিডিও। ফলে মার্ক এই ঘটনার দায় স্বীকার করে জাতিসংঘের কাছে বিবৃতি দেন ও সকলের কাছে ক্ষমা চান। ২০১৯ এর জুলাইয়ে ফেডারাল ট্রেড কমিশন থেকে ফেসবুককে ৫ বিলিয়ন ডলার ফাইন করা হয় এত মানুষের তথ্যকে ঝুঁকিতে ফেলার জন্য। অক্টোবর ২০১৯ এ ফেসবুক কোম্পানি তাদের ফাইন মিটিয়ে দেন আবং ক্যাম্ব্রিজ অ্যানালেটিকা দেউলিয়া হয়ে যায়। এছাড়াও নানা সময়ে ফেসবুকের বিরুদ্ধে ছোট বড় নানা অভিযোগ উঠলেও পরবর্তীতে সেগুলো শুধরে নিয়ে মার্ক ফেসবুককে নিয়ে গিয়েছেন এক অন্য উচ্চতায়।

 

বর্তমানে ফেসবুক

ফেসবুক বর্তমানে হয়ে উঠেছে একটি শক্তিশালী প্লাটফর্ম। এখানে যেমন কাজে নিয়োজিত হচ্ছেন হাজার মানুষ তেমন কেউ হয়ে উঠছেন সেলেব্রেটি। বিল্পবী থেকে শুরু করে কবি, লেখক ,নায়ক, গায়ক- সবাই ব্যবহার করেন এটি। বিশ্বের প্রায় সকল দেশে পৌঁছে গেছে এই সাদা নীলের যোগাযোগ মাধ্যমটি।

২০২১ সালে Facebook Inc. থেকে কোম্পানীর নাম বদলে মেটা (Meta inc.০ রাখেন। প্রতিশ্রুতি দেয়া হয় প্রাইভেসি থেকে শুরু করে ব্যবহারকারীকে সবরকম সুরক্ষা প্রদানে সর্বোচ্চ চেষ্টা করবে মেটা। এছাড়া “মেটাভার্স” (Metaverse) নামের ভার্চুয়াল জগতও তৈরী করছেন মার্ক, যেটি হবে আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স ও ব্যবহারকারীদের এক মেলবন্ধন। ২০২৩ সালে ফেসবুক এক বছরে প্রায় ১৩৪ বিলিয়ন ডলার ইনকাম করে যা ২০২২ সালে ছিলো ১১৯.২ বিলিয়ন। এ থেকেই বোঝা যায় ফেসবুক দিন দিন কতটা জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। বর্তমানে ফেসবুক প্রতিদিন ব্যবহার করেন প্রায় ২.০৯ বিলিয়ন মানুষ যা ক্রমবর্ধমান এবং মাসিক ব্যবহারকারীর সংখ্যা প্রায় ৩.০৫ বিলিয়ন।

ফেসবুক ছাড়াও মার্ক বর্তমানে ফেসবুক ম্যাসেঞ্জার (Massanger), থ্রেডস (Threads), ইন্সটাগ্রাম (Instagram), হোয়াটসঅ্যাপ (Whatsapp) সহ আরো বেশ অনেকগুলো কোম্পানি ও সোশ্যাল মিডিয়ার মালিক। ফেসবুকের পাশাপাশি এ অ্যাপগুলোও বর্তমানে বেশ জনপ্রিয় এবং এগুলো সবই মেটার অধীনে কাজ করে।

যদিও ফেসবুকের প্রথম উদ্দেশ্য ছিলো খুবই স্বল্প পরিসরে যোগাযোগের ক্ষেত্র তৈরী করা- তবে আজ আর সেটি নেই। আজ পৃথিবীর এক প্রান্ত থেকে অপর প্রান্ত সেকেন্ডের মধ্যেই যুক্ত হয়ে যাচ্ছে এই ছোট একটি অ্যাপ এক মাধ্যমে। যদিও আপনার ফোনে এটি মাত্র ৬০ মেগাবাইটের জায়গা দখল করে, প্রকৃতপক্ষে এটি পৃথিবীতে আরো অনেক বেশি জায়গা দখল করে আছে। ফেসবুক এখন আমাদের দৈনন্দিন জীবনের বড় এক অংশ। এমন কি ফেসবুকের মাধ্যমে বিপ্লবও ঘটেছে এমন ঘটনাও কম নয়। নানা সময়ে নানা অভিযোগের ভীড়েও, সবসময় ছাইরঙা টি শার্টের সাধাসিধে এই দুর্দান্ত বুদ্ধিসম্পন্ন মানুষটি কিন্তু ফেসবুক নিয়ে কাজ করা থামাননি। বরং কিভাবে এটিকে আরো উন্নত করা যায় সেই চেষ্টাই করেছেন। তার অধ্যবসায় আমাদেরকে উপলব্ধি করায় যে শুরুটা যতই ছোট হোক, না থেমে নিরন্তর চেষ্টা করে গেলে সাফল্য আসবেই।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *