স্টোরিটেলিং বলতে সাধারণত আমরা বুঝি গল্প বলা বা লেখাকে। দর্শক শ্রোতা বা পাঠকদের মনোরঞ্জনের জন্যই এটি উপযুক্ত বলে ধরে নেয়া হয়। কিন্তু আপনি কি জানেন মেন্টাল হেলথ ভালো রাখার জন্য স্টোরিটেলিং খুবই পাওয়ারফুল একটি শক্তি। কমবেশি আমরা সবাই কিন্তু স্টোরিটেলার। বাইরে পরিবারের সদস্যদের সাথে ঘুরতে যেয়ে তাদের মন ভালো করার জন্য গল্প বলে, সম্পর্কের শুরুতে গল্প বলে মুগ্ধ করা সবই কিন্তু স্টোরিটেলিং। আমরা যখন কোনো অনুষ্ঠান, চরিত্র, কাজ, অনুভূতি, আইডিয়া বা এমন যা কিছু নিয়েই কথা বলি না কেন, সবই কিন্তু কোনো না কোনোভাবে স্টোরিটেলিং এর সাথে যুক্ত। এই গল্প বলা কীভাবে মেন্টাল হেলথ ভালো রাখতে সাহায্য করে?
গল্প বলার সাথে মস্তিষ্কের সম্পর্ক
মানবজীবনের খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি অংশ হচ্ছে গল্প বলা। হাজার হাজার বছর ধরে এই গল্প আমাদের পৃথিবীর অর্থ বুঝতে শিখিয়েছে, সম্পর্ক তৈরি করিয়েছে, জ্ঞান ও ঐতিহ্য জানিয়েছে। কিন্তু আমরা গল্পে কেন এত ডুবে যাই?
প্রথম কারণ – গল্পে নিমগ্ন হয়ে যাওয়ার প্রথম কারণ হচ্ছে সেন্সরি স্টিমুলেশন। আমরা যখন কোনো গল্প শুনি, তখন আমাদের মস্তিষ্ক এমনভাবে রিয়েক্ট করে যে সেটাই প্রথম অভিজ্ঞতা। এরপর অডিটরি কর্টেক্স অ্যাকটিভেট হয় শব্দ শোনার জন্য। এরপর সেন্সরি কর্টেক্স দৃশ্য, ঘ্রাণ, স্বাদ ও নড়াচড়ার বিষয়গুলো কল্পনা করতে থাকে। এগুলো সবই আমাদের মস্তিষ্কে নতুন নতুন অভিজ্ঞতার জন্ম দিতে থাকে। এরপর মোটর কর্টেক্স অ্যাকশন ও রিয়্যাকশন স্টিমুলেট করে।
দ্বিতীয় কারণ – গল্প আমাদেরকে তথ্য একত্রিত করতে সাহায্য করে। মানুষের মস্তিষ্ক প্যাটার্ন ডিটেক্ট করতে পারে। যখন তথ্য সামনে আসতে থাকে, তখন প্যাটার্নগুলো লজিক্যাল সিকোয়েন্সে জড়ো হতে থাকে। এভাবে গল্পগুলো মস্তিষ্ককে প্লট বুঝতে সাহায্য করে।
তৃতীয় কারণ – স্টোরিটেলিং সব সময় সামাজিক বন্ধন বাড়ায়। কারণ মানুষ সামাজিক জীব, আর একে অন্যের সাথে কানেক্টেড। আমরা যখন একা থাকি, তখন এই গল্পই আমাদের বেঁচে থাকার খোরাক জোগায়। আমাদেরকে বুঝতে শেখায় এবং সহমর্মি হতে শেখায়। গল্পের একেকটা চরিত্রের সাথে আমাদের সংযোগ ঘটায়।
স্টোরিটেলিং যেভাবে মেন্টাল হেলথ ভালো রাখে
আপনি যখন গল্প বলেন, তখন মস্তিষ্কে ইতিবাচক কিছু নির্দেশনা আসে। শুধু গল্প বলে, গল্প শুনে বা নিজেদের মধ্যে গল্প আদান প্রদানেই ভালো কিছু হয় যা আমাদের মানসিক স্বাস্থ্য ভালো রাখে। চলুন এ ব্যাপারে বিস্তারিত আরও জেনে নেয়া যাক।
১) শোনার দক্ষতা বাড়ায়
ধরুন কেউ একজন গল্প বলছে এবং আপনি বেশ আগ্রহ নিয়ে সেই গল্প শুনছেন। এতে কী হবে জানেন? আপনি খুব ভালো একজন শ্রোতা হয়ে উঠবেন যা বেশ বড় একটি সামাজিক দক্ষতা। তাছাড়া আপনার কল্পনাশক্তিরও উন্নতি হবে। যদি গল্পের বই পড়ার অভ্যাস থাকে, তাহলে চিন্তাশক্তি বৃদ্ধি পায়। মস্তিষ্ক ভালো রাখার জন্য কিন্তু বই খুব ভালো ব্যায়াম হিসেবে কাজ করে। ভালো চিন্তাশক্তি কখনো কখনো মানুষের জীবন থেকে স্ট্রেসকেও দূরে রাখে।
আমরা যখন কোনো ভয়ের সিনেমা দেখি, তখন তাতে ডুবে থাকি। এইটুকু সময়ে আমরা পুরো কল্পনার জগতে চলে যাই। এর মানে হচ্ছে সিনেমাটির লেখক, পরিচালক, কস্টিউম ডিজাইনার, প্রোডাকশন ক্রু এবং বাকিরা এই গল্পটি যে আমাদের জন্য বানিয়েছেন, তারা এতে পুরোপুরি সার্থক।
২) সহমর্মিতা বাড়ে
আমরা যখন গল্পের সাথে যুক্ত হয়ে যাই, তখন আমাদের মস্তিষ্ক থেকে অক্সিটসিন রিলিজ হয়। অক্সিটসিন এক ধরনের সহমর্মিতা, যা আমাদের সম্পর্ক গভীর করতে এবং বন্ধন অটুট রাখতে বিল্ডিং ব্লক হিসেবে কাজ করে। সহমর্মিতা বাড়ানোর জন্য, গল্প বলার সময় আমাদের স্মৃতিশক্তির উন্নতি হয়। গল্প বলতে বলতে পুরনো সময়ে ফিরে যাওয়া হয় বলে স্মৃতিতে অনেক কথাই ফিরে ফিরে আসে। যেগুলো হয়ত একা থাকলে খুবই কম মনে করা হয়। আর গল্প বলে পুরনো স্মৃতি আওড়ালে একে অন্যের প্রতি সেই সহমর্মিতাও বাড়ে।
৩) পজিটিভ ইমোশন বাড়ে
গল্প বলা কীভাবে আমাদের মুড ও সেলফ ইমেজকে কন্ট্রোল করে সেটা নিয়ে বেশ গবেষণা হয়েছে। স্টোরিটেলিং মুহূর্তেই আমাদের মুড বদলে দিতে পারে এবং চাঙ্গা করে তুলতে পারে। এতে আমরা জীবনে যে বাঁধার মুখোমুখি হই সেগুলো পার হওয়া এক সময় সহজ মনে হতে থাকে। হাসপাতালের ইনটেনসিভ কেয়ারে ভর্তি থাকা বাচ্চাদের নিয়ে এক গবেষণায় জানা যায়, স্টোরিটেলিং সেশনের পর, তাদের মাঝে অক্সিটসিন রিলিজের মাত্রা বেড়ে গিয়েছে, কর্টিসল ও পেইন কমেছে, মোট কথা, পজিটিভ ইমোশন বেড়েছে বাচ্চাদের মাঝে।
৪) ডিমেনশিয়াতে সাহায্য করে
যাদের ডিমেনশিয়া আছে, তারা যদি স্টোরিটেলিং সেশনে অংশ নেয়, তাহলে নানাভাবে তারা উপকৃত হতে পারে। যেমন- গান শোনা, ছবি দেখা ইত্যাদি। যে কোনোভাবে গল্প বলা বয়স্ক ব্যক্তিদের স্মৃতি ফিরিয়ে আনতে খুব ভালো কাজ করে।
৫) একে অন্যের সাথে সম্পর্কের উন্নতি করে
গল্প বললে যে শুধু বক্তা ও শ্রোতার মধ্যে সম্পর্ক তৈরি হয় তা কিন্তু নয়। বিজ্ঞানীরাও জানিয়েছেন এতে সাধারণ মানুষদেরও একে অন্যের মাঝে কানেকশন তৈরি হয়। বিজ্ঞানীরা যখন নিজেদের কাজ নিয়ে কারও কাছে ব্যাখ্যা করেন, কীভাবে সব প্রসেস ডেভেলপ হয়েছে সেগুলো নিয়ে বলেন, বিভিন্ন তথ্য শেয়ার করেন, তখন এমনভাবে বলেন যেন সেগুলো ব্যক্তিগত কোনো বিষয়। অথবা যিনি বা যারা শুনছেন তাদেরকে পুরো গল্পের মতো সাজিয়ে শোনান। আর এ কারণে তাদের সাথেও সাধারণ মানুষের সম্পর্ক তৈরি হতে পারে।
৬) সফলতা ও হার সমন্বয়ে সাহায্য করে
গল্পের ধরন দুই ধরনের হতে পারে। সফল হওয়া ও হেরে যাওয়া। দুটোরই ইতিবাচক দিক আছে। অনেক গবেষণায় দেখা গিয়েছে, বিজ্ঞানীরা আলাদা আলাদাভাবে দুটো নিয়েই গবেষণা করে জানতে পেরেছেন, দুই ধরনের গল্পই ইতিবাচকভাবে সেলফ মোটিভেট করতে পারে।
সফলতার গল্প যেমন মানুষকে লক্ষ্য অর্জনের কথা ইফেক্টিভ ওয়েতে মনে করিয়ে দেয়, তেমনই তাদের আত্মবিশ্বাস এত বাড়ায় যে পরবর্তীতে সফল হওয়ার জন্য আরও উৎসাহিত করে।
অন্যদিকে, হেরে যাওয়ার গল্পও সমানভাবে শক্তিশালী। যখন নতুনভাবে সে গল্প বলা হয়, তখন নিজেদের চেষ্টার কথা সামনে আসে, চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করার আগ্রহ তৈরি হয় এবং ভবিষ্যতে নিজেকে কীভাবে আরও কঠিন পরিস্থিতির জন্য প্রস্তুত করা যায় তা বোঝা যায়।
৭) গল্পের নতুন ধারা তৈরি করা যায়
গল্প বলা এক ধরনের থেরাপির মতো। এই থেরাপিকে কাজে লাগিয়ে অনেক সমস্যার সমাধান জীবনে করা যায়। অস্বস্তিকর বিশ্বাসকে চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিয়ে পুনরায় নতুন গল্প তৈরি হয় জীবনের জন্য। এতে পুরনো গল্প খোলস ছেড়ে নতুন গল্প হিসেবে সামনে আসে। আর এই যে ভিন্ন ধারা বেছে নেয়া, এতে মেন্টাল হেলথেরও উন্নতি হয়। গল্প কীভাবে বলা হচ্ছে তার উপর নির্ভর করে অন্যদের সাথে কানেকশন তৈরি হয়, জীবন অর্থবহ হয়, জীবন আরও গোছানো হয় এবং নিজেরাই জড়িয়ে যায় অন্যদের গল্পে। আর এটাও স্টোরিটেলিং এর সৌন্দর্য।
গল্প বলাকে অনেক সময় আমরা তেমন একটা গুরুত্ব দেই না। ভাবি, যে বলছে সে সব সময় এভাবেই কথা বলতে থাকে। আসলে সত্যিটা হচ্ছে গল্প এমন এক বিষয় যা আমাদের মাঝে সামাজিকতা তৈরি করতে পারে। আপনি হয়ত অনেকক্ষণ ধরে শুনেই যাচ্ছেন, কিছু বলছেন না, কিন্তু একটা সময় আপনিও বলবেন, যুক্ত হবেন গল্প বলায়। আর এটাই গল্প বলা বা স্টোরিটেলিং এর ধারাকে সমন্বিত করে রেখেছে, ধরে রেখেছে এর সৌন্দর্য। আপনি হয়ত ভাবছেন, আপনি কথা বলবেন, আপনি কীভাবে গল্পকার হবেন? কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, আমাদের সবার মাঝে একজন করে গল্পকার আছে। যে শুধু নিজের গল্প নয়, অন্যের গল্পও জানে। যত বেশি গল্প বলার অংশ হবেন, তত আপনার মেন্টাল হেলথ ভালো থাকবে।