সফলতার সংজ্ঞা কী? একেক মানুষের কাছে এর সংজ্ঞা একেক রকম। এ ব্যাপারে একটি জনপ্রিয় উক্তি আছে। ‘সফলতা সব সময় ‘মাহাত্ন্য’ নয়। এটা এক ধরনের একচেটিয়া কাজ করে যাওয়ার মতো ব্যাপার। নিয়মিত পরিশ্রম করে যেতে থাকলে সফলতা আসবেই। সাথে সাথে মাহাত্ম্যও আসবে।’ একেকজনের জীবনে সফলতা একেকভাবে আসে। তবে এর ম্যাসেজ সবার ক্ষেত্রেই এক। সেটা হচ্ছে- আপনাকে এর জন্য সঠিক ইচ্ছা পোষণ করতে হবে এবং সেই অনুযায়ী পরিশ্রম করতে হবে। সফল মানুষদের দুয়ারে সফলতা এক দুই দিনে আসেনি। দিনের পর দিন তারাও পরিশ্রম করে গিয়েছেন। সাথে আয়ত্ত করেছেন কিছু অভ্যাস। এমনই কয়েকটি অভ্যাস নিয়ে আজ কথা বলব।
সফল মানুষদের দুয়ারে সফলতা এসেছে যেভাবে
সফলতা হচ্ছে সেটাই, যেটা আপনি পছন্দ করেন, আপনার করতে ভালো লাগে, আপনি জানেন সেটা কীভাবে করতে হয়। – মায়া এঙ্গেলও
সফলতা হচ্ছে সেই লক্ষ্য যেটা পুরণ করার জন্য আপনাকে এফোর্ট দিতে হয়, সঠিক ইচ্ছা পোষণ করতে হয় এবং সেই অনুযায়ী আপনার গ্রোথ হয়। এক কথায় আপনি কতটুকু ভালো থাকবেন, সেটাও নির্ধারিত হয় এর মাধ্যমে। সফলতার প্রতীক হতে পারে সম্পদ, ঐশ্বর্য, পরিচয় যে কোনো কিছু। তবে যেটাই হোক না কেন, সফল মানুষদের দুয়ারে সফলতা আসে কিছু অভ্যাসের মাধ্যমে। আর এমনই কয়েকটি অভ্যাসের কথা আজ আমরা জানবো।
১) তারা নিয়মিত বই পড়েন
Change Your Habits, Change Your Life বইয়ের লেখক টম করলে জানান, ৮৮% সম্পদশালী মানুষ সেলফ ইমপ্রুভমেন্টের জন্য অন্তত ৩০ মিনিট সময় বের করেন। পড়ার কারণে নতুন নতুন টুলস সম্পর্কে জানা যায় এবং সফল ব্যক্তিদের অভ্যাসে এক সময় পড়া জরুরি একটি বিষয় হয়ে দাঁড়ায়।
বেশি বেশি পড়ার কিছু টিপস
- একই সময়ে কয়েকটি বই পড়া শুরু করতে পারেন
- পড়ার স্টাইল চিহ্নিত করুন- পড়তে ভালোবাসেন নাকি শুনতে?
- যখন যা ভালো লাগে এমন ভিন্ন ভিন্ন টপিক বেছে নিন
- দিনে যে সময় পড়তে বেশি ভালো লাগে সেই সময়ই পড়ুন
- অডিও বুক, কিন্ডল, ডিজিটাল যে কোনো মাধ্যম – যেখান থেকে পড়তে ভালো লাগে পড়ুন
২) কাজের আগে ব্যক্তিগত জীবনের জন্য সময় বের করেন
প্রতিদিন সকাল সাড়ে আটটায় ঘুম থেকে উঠে অপরাহ উইনফ্রে দাঁত ব্রাশ করেন, কুকুরদের বাইরে হাঁটতে নিয়ে যান, এসপ্রেসো বানান, ইন্সপিরেশনাল মন্ত্র পড়েন, এরপর প্রস্তুতি নেন সকালের মেডিটেশনের জন্য। এরপর ঘন্টাখানেক কার্ডিও করেন বা অন্য কোনো এক্সারসাইজ করেন, কাজ শুরু করেন লাঞ্চের পর থেকে। তার এই রুটিন দেখে বোঝা যায় প্রোডাক্টিভিটি বাড়ানোর জন্য কাজ শুরু করার আগে ব্যক্তিগতভাবে নিজেকে কিছুটা সময় দেয়া উচিত। গবেষণা অনুযায়ী, ৯২% শতাংশ সফল মানুষের একটি নির্দিষ্ট মর্নিং রুটিন আছে।
যেভাবে সকালে নিজেকে সময় দিবেন
- দিনের শুরুতে অন্তত ঘন্টাখানেক মোবাইল দেখা বন্ধ রাখুন
- বিছানা থেকে নামার আগেই সারাদিন কী কী করবেন তার একটি মাইন্ডসেট করে নিন
- নতুন রুটিন সেট করার আগে অভ্যাস তৈরি করুন
- প্রতিদিন অন্তত ১৫ মিনিটের জন্য হলেও টাইম ম্যানেজমেন্ট প্র্যাকটিস করুন
৩) প্রতিদিনের রিফ্লেকশন নিয়ে সময়ের প্রতি ফোকাসড থাকেন
ন্যাশনাল সায়েন্স ফাউন্ডেশন এর দেয়া একটি তথ্যমতে, প্রতিটি মানুষের চিন্তা ও অনুভূতি তার মেন্টাল পারফরম্যান্সের উন্নতি করে। জার্নালিং শুধু ভিশনের প্রতি ক্লিয়ারই রাখে না, একটির সাথে আরেকটি বিষয়ের কানেকশনকে সেলফ রিফ্লেকশনের মাধ্যমে বোঝায়। রিচার্ড ব্র্যানসন, জে কে রাওলিং, টিম ফেরিস এর মতো সফল অনেক মানুষ তাদের দিন শুরু করতেন সেলফ রিফ্লেকশন ও মেডিটেশনের মাধ্যমে।
প্রতিদিনের রিফ্লেকশনের জন্য যা যা প্র্যাকটিস করবেন
- একটি ভিশন বোর্ড বানাবেন, যেটি প্রতিদিন সকালে উঠেই দেখতে পাবেন
- ১০-১৫ মিনিট ভিজ্যুয়ালাইজেশন মেডিটেশন করবেন
- ফোকাস ও কনফিডেন্স বাড়ানোর জন্য ওয়েলনেস জার্নাল কিনে নিতে পারেন
- প্রতিদিন সকালে SMART গোল সেট করে নিন এবং সে অনুযায়ী প্ল্যান করুন
- রিফ্লেকশন ও মাইন্ডফুলনেসের জন্য মেন্টাল হেলথ অ্যাপস ব্যবহার করুন
৪) মাল্টিপল গোল ও সোর্স অফ ইনকাম থাকে
সিএনবিসি’র একটি সাক্ষাৎকারে রিচ হ্যাবিটস বইয়ের লেখক টম করলে বলেছিলেন, ২৩৩ জন সম্পদশালী মানুষের ভেতর ৬৫% মানুষের অন্তত তিনটি ভিন্ন ধরনের ইনকাম সোর্স আছে। বাকি ৪৫% এর চারটি এবং ২৯% এর ৫টি বা তারও বেশি আছে। সব ইনকাম এক জায়গা থেকে করার বদলে আলাদা আলাদা ইনকাম সোর্স খুঁজে বের করলে যে লাভ হতে পারে সেটা সফল ব্যক্তিরা জানেন।
- সফল ব্যক্তিদের কয়েকটি অ্যাডিশনাল ইনকাম সোর্স
- side hustle থেকে ইনকাম করা
- স্টক, মিউচুয়াল ফান্ড থেকে ইনকাম করা
- বাসা, অ্যাপার্তমেন্ট ও কমার্শিয়াল রিয়েল এস্টেট প্রোপার্টিজ থেকে ভাড়া পাওয়া
- ইনটেলেকচুয়াল প্রোপার্টিজ, যেমন- কপিরাইট, ট্রেডমার্ক ও ইনভেনশন থেকে রয়্যালিটি পাওয়া
- ফ্র্যাঞ্চাইজ, ব্লগ ও সার্ভিস থেকে ইনকাম করা
৫) প্রতিদিন এক্সারসাইজ করা
প্রতিদিনের এক্সারসাইজকে সফলতার মূল চাবিকাঠি বলা যাবে না। এগুলো হচ্ছে এমন কিছু অভ্যাস যেগুলো করলে শারীরিক ও মানসিক উপকার পাওয়া যায়। আর এই কারণে যে সকল সফল মানুষদের দুয়ারে সফলতা এসেছে তারা কখনো প্রতিদিন এক্সারসাইজ করা বাদ দেন না।
প্রতিদিন এক্সারসাইজ করার কিছু টিপস
- আপনি দৌড়াতে ভালোবাসেন? সাঁতার কাটতে? সাইকেল চালাতে? যেটা করতে ভালো লাগে সেটাই করুন।
- ব্যায়ামের জন্য সকাল সবচেয়ে ভালো, তবে না পারলে দিনের যে কোনো সময় সিলেক্ট করে নিতে পারেন।
- অভ্যাসগুলোকে আপন করে নিন, সেলফ কমপ্যাশন প্র্যাকটিস করুন এবং লক্ষ্য নির্ধারণ করুন।
- ফিটনেস অ্যাপগুলো ফলো করে ভার্চুয়াল ওয়ার্কআউটও করতে পারেন।
৬) সময় ও পরিশ্রমকে অর্গানাইজ করেন
ডেইলি প্ল্যানার, অর্গানাইজারস, চেকলিস্ট, টাস্ক শিট – এসবই হাইলি ইফেক্টিভ মানুষদের হাতিয়ার বলা যায়। ৬৩% শতাংশ মানুষ রাতে অ্যালার্ম দিয়ে রাখেন এবং ৪৪% মানুষ আগের রাতেই তাদের পরের দিনের প্ল্যান সাজিয়ে ফেলেন। সফল ব্যক্তিরা আরও একটি কাজে খুব পারদর্শী হন, সেটি হচ্ছে টাইম ম্যানেজমেন্ট। বেশিরভাগ মানুষ তাদের মোবাইল দেখা দিয়ে দিনের শুরুটা করেন, যেখানে সফল ব্যক্তিরা তাদের সময়কে কাজে লাগান লিডারশীপ ও ম্যানেজমেন্ট স্কিল শেখা দিয়ে।
স্ট্র্যাটেজি যেভাবে অর্গানাইজ করতে পারেন
- শিডিউল টাস্কের জন্য সময় বের করুন
- পারসোনাল ও প্রফেশনাল গুরুত্ব বুঝুন
- চ্যালেঞ্জিং ও হাই প্রায়োরিটি কাজগুলো আগে করুন
- সুযোগ কম আছে এমন কাজের জন্যও পরিবেশ তৈরি করুন
৭) অন্য সফল ব্যক্তিদের সাথে সংযুক্ত থাকেন
আপনার আশেপাশে যদি এমন মানুষ থাকে যারা সব সময় বড় হওয়ার চিন্তা করে, তাহলে তাদের আইডিয়া ও এনার্জি কিছুটা হলেও আপনার মাঝে প্রতিফলিত হবে। আপনার জীবন বদলে দিতে পারে আপনার ব্যবসা, সম্পর্ক। তাই বুদ্ধিমত্তার সাথে সেগুলো বেছে নিন। যদি আশেপাশে এমন মানুষ থাকে যারা আপনাকে নিচে নামাতে চায় বা পিছনে তেনে ধরে, তাহলে তাদের পিছনে ফেলে আসার দায়িত্ব আপনারই।
অন্য সফল ব্যক্তিদের যেভাবে সাথে রাখবেন
- খেয়াল করুন আপনার লক্ষ্য পূরণে কারা সহায়তা করে
- আপনাকে নিচু দেখায় বা আনকনফিডেন্ট ফিল করায় এমন সম্পর্ক থেকে নিজেকে মুক্তি দিন
- যে কোনো প্রফেশনাল গ্রুপ, মেন্টরশীপ প্রোগ্রাম বা মাস্টারমাইন্ড গ্রুপে যোগ দিন
- প্রফেশনাল ওয়ার্কশপ বা কনফারেন্সে যোগ দিন
৮) অন্যকে সার্ভ করার মাধ্যমে সফলতা আকর্ষণ করে
সফল ব্যক্তিরা ভাবেন তারা অন্যকে সাহায্য করার মাধ্যমে পজিটিভিটি ছড়াতে পারবেন। একে বলে ল’ অফ অ্যাট্রাকশন। অর্থাৎ পজিটিভিটি দিয়ে পজিটিভিটি ফিরিয়ে আনা।
যেভাবে সফলতা আকর্ষণ করা যায়
- যে কোনো ব্যবসা করুন, চ্যারিটি বা ব্যক্তিকে সময় বা রিসোর্স ডোনেট করুন
- প্রিয়জন, কলিগ বা বন্ধুদের জন্য সময় বের করুন
- লোকাল অর্গানাইজেশন বা উদ্যোগ খুঁজে বের করুন যেখানে সময় বা স্কিল দিয়ে ভলান্টিয়ারি করা যাবে
- ফান্ড রাইজিং ইভেন্ট, এলাকা পরিষ্কারের মতো সামাজিক কাজগুলো করতে পারেন
৯) একে অন্যের খেয়াল রাখেন
সফল ব্যক্তিরা শুধু পরিকল্পনা করে চলেন না, তারা জানেন কীভাবে প্ল্যান করতে হয়, তারা জানে কাদের গুরুত্ব দিতে হয়- আর তাই তো একে অন্যকে ভালোভাবে জানার সুযোগ তৈরি হয়। এনার্জি ধরে রাখার জন্য সফল ব্যক্তিরা নিয়মিত খাওয়াদাওয়া করেন, পর্যাপ্ত বিশ্রাম নেন, হেলদি লাইফস্টাইল মেইনটেইন করেন।
কয়েকটি সেলফ কেয়ার টিপস
- পর্যাপ্ত ঘুমানোর ব্যবস্থা রাখুন
- পুষ্টিকর খাবার খান শরীর ও মনকে সুস্থ রাখার জন্য
- আনহেলদি সিচুয়েশন ক্রিয়েট করে এমন মানুষ এড়িয়ে চলুন
- নিয়মিত ফিজিশিয়ানের সাথে যোগাযোগ রাখুন এবং শরীরের কথা শুনুন
১০) মেডিটেশন করেন এবং পজিটিভ থাকেন
সফল মানুষদের দুয়ারে সফলতা আসে নিজেদের পজিটিভ রাখা এবং মেডিটেশন করার মাধ্যমে। যে সমস্ত জিনিস করলে আপনার ভালো লাগে সেগুলো নিয়মিত চর্চা করুন। নেপোলিয়ন বলেন, ‘পজিটিভ মাইন্ড সব সময় কাজ শেষ করার রাস্তা খোঁজে, আর নেগেটিভ মাইন্ড খোঁজে কীভাবে কাজটি শেষ না হয়।’
পজিটিভিটি যেভাবে প্র্যাকটিস করা যায়
- যে কাজগুলো করতে ভালো লাগে সেগুলোর একটি তালিকা রাতে তৈরি করুন
- দিনে অন্তত দুই মিনিট নিজেকে দিন
- মেডিটেশনের জন্য মেন্টাল হেলথ অ্যাপ ফলো করুন
সফলতা একটি ছোট শব্দ হলেও এর ব্যাপ্তি ব্যাপক। সফল মানুষদের দুয়ারে এই সফলতা একদিনে আসেনি। দিনের পর দিন ক্রমাগত ভালো অভ্যাস মেনে চলার কারণে এই দিন তারা পেয়েছেন। তাই এক দুইদিন নয়, অভ্যাসের চর্চা হোক প্রতিদিন, তবেই তো সফল মানুষের দুয়ারে সফলতা এসে কড়া নাড়বে।