বয়স বাড়ার সাথে সাথে শান্তিপূর্ণ জীবন চাইলে এই অভ্যাসগুলো বাদ দিন

বড় হওয়া মানে শত দায়িত্বের ভিড়ে চাপা পড়ে যাওয়া। কিন্তু তার মানে এই নয় যে কিছু খারাপ অভ্যাস প্র্যাকটিস করে মনের শান্তি নষ্ট করে ফেলবেন। এ কথা কেন বলছি? বলছি কারণ, প্রতিদিনের জীবনে চলতে ফিরতে এমন কিছু অভ্যাস আমরা আয়ত্ত করে ফেলি যেগুলোর কারণে জীবনে হতাশা বাড়ে, ঝামেলা সৃষ্ট হয়। এই অভ্যাসগুলোর কারণে যৌবনে হয়ত তেমন সমস্যা হয় না, কিন্তু বয়স বাড়ার সাথে সাথে ঝামেলা সৃষ্টি হতে থাকে। সেই অভ্যাস কোনগুলো? চলুন জেনে নেয়া যাক।

বয়স বাড়ার সাথে সাথে যে অভ্যাসগুলো বাদ দিতে হবে

১) অতিরিক্ত সমালোচনা করা

আমরা যত বড় হই, তত সমালোচনা করতে থাকি। এটা খুব একটা খারাপ অভ্যাস নয় বরং সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে এবং হোঁচট খাওয়ার সম্ভাবনা কমায়। কিন্তু এটা যদি অভ্যাস হয়ে যায়, তাহলে আমাদের মানসিক শান্তিকে এক নিমেষে দূর করে ফেলতে পারে। আমাদের চারপাশে যারা আছে, আমরা শুধু তাদেরই ক্রিটিসাইজ করি না, বরং নিজেদেরকেও করি। যেটা কোনো লাভ তো আনেই না, বরং বাড়তি দুশ্চিন্তা ও হতাশা বাড়ায়।

আরও খারাপ ব্যাপার হচ্ছে, এর কারণে আমাদের আচরণ বদলাতে থাকে, সবার কাছে বিরক্তিকর মনে হতে থাকে। আপনি বড় হওয়ার সাথে সাথে যদি এই অভ্যাস রপ্ত করে ফেলেন, এক সময় দেখবেন আপনি ভালো কোনো কথাই বলতে পারছেন না। তাই সমালোচনাকে রিপ্লেস করে অন্যকে বুঝুন। এতে জীবন সুন্দরভাবে বদলে যাবে।

বয়স বাড়ার সাথে সাথে সমালোচনাও বাড়ছে?

২) মনের মাঝে কথা রেখে দেয়া

এমন হতেই পারে যে কারো সাথে কোনো কথা নিয়ে মনোমালিন্য হলো বা আপনাকে কেউ মন খারাপ করা কথা বলে ফেলল। আপনি সেই কথাগুলোকে দিনের পর দিন মনের ভেতর রেখে দিলেন। ভাবতে পারেন, নতুন করে কারও আঘাত থেকে বাঁচার জন্য এটাই ভালো উপায়। কিন্তু বয়স বাড়ার সাথে সাথে বুঝতে পারবেন এগুলো আসলে আপনাকে কোনোকিছু থেকে সুরক্ষিত রাখবে না। বরং এর উল্টোটা হবে। এটাকে মনে হতে থাকবে আপনি কাঁধে কোনো ব্যাকপ্যাক বয়ে নিয়ে চলছেন, যেখানেই যাচ্ছেন। আর এ কারণে আপনার মানসিক অবস্থাও খারাপ হচ্ছে দিন দিন। এ পরিস্থিতি থেকে বের হওয়ার জন্য এসব কথাকে সাথে নিয়ে ঘোরা যাবে না। এতে নিজেকে একদম হালকা মনে হবে, জীবনে শান্তি আসবে।

৩) নিজেকে গুরুত্ব না দেয়া

আমরা সব সময় আমাদের নিজেদের আগে অন্যকে রাখি। এ কারণে প্রায়ই আমরা আমাদের প্রয়োজনকে উপেক্ষা করি, নিজের যত্ন নেয়াকে সেলফিশ ভাবতে থাকি। অথচ গবেষণা বলে, যে নিজের খেয়াল রাখে তার স্ট্রেস কম থাকে, মেন্টাল হেলথ ভালো থাকে এবং খুশি থাকে। সেলফ কেয়ার মানে শুধু স্পা করানো বা বাবল বাথ নেয়া নয়। এর মানে হচ্ছে শরীরের কথা শোনা, পুষ্টিকর খাবার খাওয়া, পর্যাপ্ত ঘুমানো এবং সময় নিয়ে আরাম করা।

৪) বদল মেনে না নেয়া

পরিবর্তন জীবনেরই একটি অংশ। অনেকেই কমফোর্ট জোনের বাইরে যেয়ে নতুন কিছু শুরু করাকে ভয় পান। আমরা একই রুটিনে ও অভ্যাসে আটকে যাই, যদিও সেটাতে কোনো ভালো কিছু হয় না। যদি জীবন একঘেয়ে ভাবেই কাটতে থাকে তাহলে আমরা আরও হতাশ হয়ে যাব এবং জীবন বিষাদময় হয়ে যাবে। বয়স বাড়ার সাথে সাথে আমাদের পরিবর্তনকে মেনে নেয়া উচিত, একে বাদ দেয়া যাবে না। সব বদলকেই যে মেনে নিতে হবে তা নয়। যেগুলো আমাদের জীবনে শান্তি নিয়ে আসে শুধু সেগুলোই মানতে হবে। যেগুলোতে আপনার কোনো উন্নতি হচ্ছে না সেগুলো জীবন থেকে বাদ দিয়ে নতুন অভিজ্ঞতাকে আমন্ত্রণ জানান।

৫) সবকিছুতে হ্যাঁ বলা

বয়স বাড়ার সাথে সাথে সবকিছুতে হ্যাঁ বলেই যাচ্ছেন?

সব কাজে বা কথায় ‘হ্যাঁ’ বলা ভালো লক্ষণ নয়। আমরা কোনো সুযোগ হাতছাড়া করতে চাই না, অন্যকে হতাশ করতে চাই না বা সহযোগিতা না করেও থাকতে পারি না। এই ওভারকমিটিং এক সময় হতাশা বাড়ায়, জীবন থেকে গুরুত্বপূর্ণ সময় হারিয়ে যায়। এতে কাজের কোয়ালিটিও কমে যায়। সত্যিটা হচ্ছে আমরা সবকিছু একসাথে করতে পারব না। আর এটা মেনে নিতেই হবে। বয়স বাড়ার সাথে সাথে ‘না’ বলতে পারা কঠিন হয়ে যায়। তাই বুঝুন কোন বিষয়কে না বলতে হবে এবং না বলার পর কোন বিষয়ে আর আফসোস করা যাবে না।

৬) নিজেকে অন্যের সাথে তুলনা করা

আমরা এমন এক জগতে বাস করি যেখানে তুলনা করাই সবকিছু। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে একে অন্যের সাথে তুলনা করা যেন বেশি সহজ। অন্যের সাথে নিজেদের সম্পর্ক, অর্জন, টিকে থাকা সবকিছু নিয়েই আমাদের তুলনা চলতে থাকে। কিন্তু সত্যিটা কী জানেন? তুলনা আমাদের জীবনের শান্তি ও আনন্দ কেড়ে নেয়। এটা আমাদের মাঝে এমন অবস্থা তৈরি করে যে আমাদের যা আছে তা পর্যাপ্ত নয়। আপনি যে ইউনিক এটা আপনার নিজের আগে বুঝতে ও বিশ্বাস করতে হবে। বয়স বাড়ার সাথে সাথে নিজের স্বত্তাকে ও উন্নতিকে বাহবা দিতে শিখুন, অন্যের সাথে নিজেকে তুলনা করার বদলে। কাল আপনি যে মানুষ ছিলেন তার চেয়ে আজকে আরও বেশি ভালো হবেন সেই প্রতিশ্রুতি নিজেকে দিন। এতে মানসিক শান্তি বজায় থাকবে।

৭) অনুভূতিকে ইগনোর করা

নিজের অনুভূতিকে একপাশে রেখে সামনে এগিয়ে চলার চেষ্টা করা বৃথা। যদি আপনি নিজে সেই অনুভূতিগুলোকে একত্রিত না করেন, তাহলে শেষ পর্যন্ত আপনিই হারিয়ে যাবেন। অনুভূতি মানুষের জীবনের সাধারণ একটি অংশ। সেগুলোকে ইগনোর করা বা বাদ দেয়া যায় না। অনুভূতিগুলো বুঝতে হয়, জানতে হয়। বয়স বাড়ার সাথে সাথে অনুভূতি প্রকাশ করতে শিখুন। খারাপ, ভালো, কুৎসিত – যাই হোক না কেন, প্রকাশ করুন। এগুলো আপনারই একটি অংশ এবং আপনাকে এগুলো শুনতেই হবে। অনুভূতিকে বসে আনতে পারলে মানসিক শান্তিও বজায় থাকবে এবং জীবনে ইমোশনাল ফ্রিডমও পাবেন।

৮) অতীতে বা ভবিষ্যতে বাস করা

অতীতে বা ভবিষ্যতে বাস করা

অতীতে কী হয়েছে তা নিয়ে আক্ষেপ করা, পুরনো কথা খুঁড়ে খুঁড়ে নিজে নিজে কষ্ট পাওয়া বা ভবিষ্যতে কী হবে তা নিয়ে ভাবতে থাকা খুব সহজ। কিন্তু সত্যিটা হচ্ছে, আমরা শুধু আমাদের বর্তমানে বাঁচি। অতীত বা ভবিষ্যৎ নিয়ে ভাবলে শুধু দুশ্চিন্তা ও হতাশাই বাড়ে। জীবনের আনন্দ এতে উপভোগ করা যায় না। বয়স বাড়ার সাথে সাথে আমাদেরকেও শিখতে হবে কীভাবে বর্তমানে বাঁচা যায়। তার মানে এই নয় যে অতীত থেকে শিক্ষা নিয়ে ভবিষ্যৎ সাজাবো না। এটাও করতে হবে, তবে বর্তমানকে সঙ্গী করেই। মেডিটেশন আমাদেরকে বর্তমান মুহূর্ত উপভোগ করতে শেখায়। আমাদেরকে জীবনের নানা মুহূর্তের অভিজ্ঞতা নিতে শেখায়।

৯) সম্পর্ক অবহেলা করা

সম্পর্ক আমাদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখে। সম্পর্ক আমাদের ভালোবাসা দেয়, সাপোর্ট দেয় এবং টিকে থাকা শেখায়। তাই একে আমাদের গ্রহণ করতেই হবে। সম্পর্ক অবহেলা করা মানে একাকীত্বকে গ্রহণ করা, যা আমাদের মানসিক প্রশান্তিকে বাঁধা দেয়। আমাদের বয়স বাড়ার সাথে সাথে সম্পর্কও মজবুত হতে থাকে। ভালোবাসার মানুষের সাথে সময় কাটানো, অনুভূতির প্রকাশ, গুরুত্ব বোঝানো সবকিছুরই দরকার আছে। দিনশেষে আমাদের কাছে কী আছে সেটা নয়, বরং কোন মানুষগুলো আছে সেটা বেশি গুরুত্ব রাখে। আর এই উপলব্ধিই মানসিক শান্তি এনে দেয়।

বয়সের বৃদ্ধি জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। এই জার্নির সাথে জড়িয়ে আছে অভিজ্ঞতা, বিজ্ঞতা ও ক্রমশ পরিবর্তন। আমরা যত বড় হই, তত বাস্তবতাকে বুঝি, নিজেকে চিনতে শিখি। তাই এই যাত্রাকে অবহেলা করা যাবে না। এই নয়টি অভ্যাস জীবন থেকে বাদ দিলে শুধু শান্তিই আসবে না, বরং আপনাকে জানাবে আপনি সত্যি সত্যি কেমন। আপনার অভ্যন্তরীণ দিক সামনে আসে এবং আপনার প্রয়োজন, চাহিদা, ইচ্ছা ও গুরুত্বকে বোঝায়। কম বয়সে ভুল হবেই। সেই ভুল থেকে শিক্ষা নিয়েই সামনে এগিয়ে যেতে হবে। তাই বয়স বৃদ্ধিতে ভয় নয়, বরং সাহসের সাথে, আনন্দের সাথে উদযাপন করুন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *