সদ্য চাকরিতে জয়েন করেছেন, নতুন নতুন সবকিছু জানছেন, শিখছেন। আপাতদৃষ্টিতে মনে হচ্ছে সবকিছু ভালোভাবেই চলছে। চাকরি বদলানোর প্রয়োজনও মনে করছেন না এ মুহূর্তে। কিন্তু এরপরও ক্যারিয়ার নেটওয়ার্কিং করা জরুরি। কারণ এক চাকরি আপনি সারা জীবন করবেন না। কখনো না কখনো নতুন জায়গায় মুভ করতেই হবে। আর শুধু জব সার্চিং এর জন্যই যে এই নেটওয়ার্কিং করতে হয় তা নয়। প্রতিদিনের নানা কাজ ও ক্যারিয়ার রিলেটেড বিভিন্ন অগ্রগতির জন্যও ক্যারিয়ার নেটওয়ার্কিং করা জরুরি। আপনি জানেন না কখন আপনার কী প্রয়োজন হতে পারে, কখন কোথায় মুভ করা জরুরি হয়ে উঠতে পারে। তাই এই নেটওয়ার্কিং ক্রিয়েট করে রেগুলার জব মার্কেটের খবর রাখা এবং সবার সম্পর্কে জেনে রাখা জরুরি।
ক্যারিয়ার নেটওয়ার্কিং এর উদ্দেশ্য
এই নেটওয়ার্কিং এর মাধ্যমে বেশ কিছু উদ্দেশ্য পুরণ করা সম্ভব হয়। যেমন- জব সার্চিং এর জন্য পারসোনাল, প্রফেশনাল, অ্যাকাডেমিক অথবা পারিবারিক যোগাযোগ রাখা যায়। নিজের অথবা অন্যের চাকরি সম্পর্কে নানা তথ্য জানা যায়। আপনি যাদের সাথে কাজ করছেন তাদের সম্পর্কে অথবা যে কাজ সম্পর্কে আপনার আগ্রহ আছে, সেগুলো সম্পর্কে খুব ভালোভাবে জানা যায় এই ক্যারিয়ার নেটওয়ার্কিং এর মাধ্যমে।
কেন সময় দিবেন এখানে?
২০১৭ সালে ক্যারিয়ার নেটওয়ার্কিং নিয়ে করা একটি সার্ভেতে কিছু তথ্য উঠে আসে। যেমন –
- ক্যারিয়ারে সফলতার জন্য প্রায় ৮০% মানুষ প্রফেশনাল নেটওয়ার্কিং থাকাকে জরুরি মনে করেন।
- ৩৫% প্রফেশনাল ব্যক্তি বলেন, লিংকড ইন এ ম্যাসেজিং এর মাধ্যমে ক্যাজুয়াল কনভারসেশন করলে নতুন কাজের ক্ষেত্র তৈরি হয়।
- ৬১% প্রফেশনাল মনে করেন নিয়মিত অনলাইনে প্রফেশনালদের সাথে কথাবার্তা বললে নতুন চাকরির সুযোগ তৈরি হয়।
কাদের সাথে নেটওয়ার্ক করবেন?
- অতীত ও বর্তমানের সহকর্মী, কলিগ, ম্যানেজার, সুপারভাইজার ও কর্মী
- অতীত ও বর্তমানের ক্লায়েন্ট ও কাস্টমার
- বিজনেস অ্যাসোসিয়েটস
- ইউনিভার্সিটির অ্যালামনাই
- ব্যক্তিগত জীবনে পরিচিত ব্যক্তি
- ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান, জিম, ইয়োগা স্টুডিও বা কম্যুনিটি অর্গানাইজেশন থেকে পরিচিত হওয়া ব্যক্তি
- অতীত ও বর্তমানের শিক্ষক বা প্রফেসর
- এমন কেউ যিনি নিজের ক্যারিয়ার নিয়ে সচেতন, প্রোডাক্টিভ ও প্রফেশনাল আলোচনা করতে পারেন
নেটওয়ার্কিং কীভাবে করবেন?
১) সঠিক ব্যক্তিকে বেছে নিন
আপনার ক্যারিয়ার নেটওয়ার্কিং এ এমন ব্যক্তি ইনক্লুড থাকতে হবে যিনি আপনাকে চাকরি খোঁজা বা ক্যারিয়ারে মুভ করার ব্যাপারে সাজেশন দিতে পারে। এই ব্যক্তি হতে পারেন অতীত বা বর্তমান কর্মক্ষেত্রের সহকর্মী, বস, আপনার মতোই ভাবে এমন কোনো বন্ধু, বিজনেস অ্যাসোসিয়েশনের কলিগ, ইউনিভার্সিটির অ্যালামনাই অথবা অনলাইন নেটওয়ার্কিং সার্ভিসের জন্য পরিচিত হয়েছেন কারো সাথে এমন কেউ। আপনার নেটওয়ার্ক হতে পারে পরিবার, প্রতিবেশি বা এমন যে কোনো ব্যক্তি যার সাথে কথা বললে ক্যারিয়ার সম্পর্কিত সাহায্য পাওয়া যাবে।
২) ক্যারিয়ার ফিল্ড সম্পর্কে জানুন
১০ জনের মধ্যে ৮ জন চাকরিপ্রার্থী স্বীকার করেন ক্যারিয়ার নেটওয়ার্ক তাদের কাজ খুঁজে পেতে সাহায্য করে। নেটওয়ার্কিং মানে শুধু চাকরিতে নেতৃত্ব দেয়া নয়। যেখানে আপনি কাজ করতে চাচ্ছেন সেই প্রতিষ্ঠানের ভেতরের নানা খবর আপনি জানতে পারবেন এর মাধ্যমে। তারা আপনাকে ক্যারিয়ার ফিল্ডের নানা তথ্য জানাতে পারবে যেগুলো আপনি জব মার্কেটে এক্সপ্লোর করতে চাচ্ছেন অথবা দেশের বাইরে চাকরির কোনো সুযোগ আছে কিনা। নেটওয়ার্ক আপনাকে জানাবে আপনি কোথায় কোথায় জব খুঁজতে পারেন বা রিজিউম কোথায় রিভিউ করাতে পারেন।
৩) যোগাযোগ রাখুন
চাকরি ছাড়তে চাচ্ছেন অথবা নতুন কোনো পজিশনে জয়েন করতে চাচ্ছেন, এমন হলেই শুধু কারও সাথে যোগাযোগ করবেন এমন যেন না হয়। নেটওয়ার্কিং নিয়মিত মেইনটেইন করুন। জাস্ট হাই হ্যালো বা কেমন দিন যাচ্ছে এসব কথা বলেও যোগাযোগ ধরে রাখা যায়। আপনি কেমন, আপনার আচরণ কেমন, কীভাবে কথা বলেন এসব জানতে পারলে অপরপক্ষের ব্যক্তিটিও আপনার প্রতি আগ্রহী হবেন এবং সাহায্য করবেন।
৪) দেয়া নেয়ার প্রচলন রাখুন
নেটওয়ার্কিং কখনো এক পাক্ষিক হওয়া যাবে না। যদি আপনি কোনো চমৎকার আর্টিকেল বা জব পোস্ট দেখেন, তখন সেটা নেটওয়ার্কে শেয়ার করুন। ক্যারিয়ার নেটওয়ার্কিং মানে হচ্ছে যেসব রিসোর্স আছে সেগুলোতে আপনার সাহায্য হবে, আবার আপনিও যতটুকু পারবেন অন্যকে সাহায্য করবেন।
৫) নেটওয়ার্কের ট্র্যাক রাখুন
পারসোনাল ক্যারিয়ার নেটওয়ার্ক কোথাও ট্র্যাক করে রাখুন। ইলেকট্রনিক্যালি হোক বা কাগজে, কে কোথায় কাজ করে, কোন ব্যক্তির কাছ থেকে কী সাহায্য পাবেন সেগুলো লিস্ট করে রাখুন।
৬) অনলাইনে নেটওয়ার্ক তৈরি করুন
লিংকড ইন, ফেইসবুক বা অনলাইন নেটওয়ার্কিং ওয়েবসাইট এর মতো অন্যান্য সাইটগুলো আপনাকে নির্দিষ্ট কোম্পানির সাথে টাচে থাকতে হেল্প করবে। আপনি যদি একজন সদ্য গ্র্যাজুয়েট হয়ে থাকেন, তাহলে আপনার ইন্সটিটিউশনের অ্যালামনাই অ্যাসোসিয়েশনের সাথে যোগাযোগ রাখুন যেন যে কোনো প্রয়োজনে এক্সেস পাওয়া যায়। যদি এমন লোকেদের সাথে আপনার নেটওয়ার্ক করতে হয় যাদেরকে আপনি চিনেন না, তখন তাদের সাথে কথা বলার সময় নিশ্চিত হয়ে নিন আপনি ঠিক কী চাচ্ছেন। আপনি কি প্রতিষ্ঠানের তথ্য চাচ্ছেন? নাকি চাকরির সুযোগ খুঁজছেন? যেটি জানতে চান সেটি সম্পর্কে নিশ্চিত হয়ে প্রশ্ন করুন।
৭) নেটওয়ার্কিং ইভেন্টে যোগ দিন
সরাসরি যেয়ে নেটওয়ার্কিং করলে সেটিও কাজ করে। আপনি যদি প্রফেশনাল হয়ে থাকেন, তাহলে মিটিং বা এ ধরনের আয়োজনে অ্যাতেন্ড করতে পারেন। আপনার মতো আরও অনেকেই যদি আগ্রহী হয়ে থাকে, তাহলে তাদের সাথে বিজনেস কার্ড এক্সচেঞ্জ করুন। আপনার শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের অ্যালামনাই যদি কোনো নেটওয়ার্কিং ইভেন্ট এর আয়োজন করে তাহলে অবশ্যই সেখানে অংশ নিন। এক কথায়, নেটওয়ার্কিং ইভেন্টে অংশগ্রহণের সুযোগ পেলে একদমই মিস করা যাবে না।
ক্যারিয়ার ডেভেলপমেন্টের জন্য নেটওয়ার্কিং কেন জরুরি?
১) সামাজিকভাবে ভালো রাখে
নেটওয়ার্কিং আপনাকে সামাজিকভাবে ভালো রাখে এবং সারাজীবনের জন্য বন্ধু তৈরি করতে সাহায্য করে। আপনি হয়ত শুধু নেটওয়ার্কিং এর প্রফেশনাল দিকটাতেই ফোকাস করছেন। কিন্তু এমন অনেক বন্ধুত্ব আছে যেগুলো ওয়ার্কপ্লেসে শুরু হয় অথবা কোনো প্রফেশনাল ফাংশনে। নেটওয়ার্কিং মানে শুধু নেয়া না – বরং সমানভাবে দেয়াও, যেটা বন্ধুত্বকে আরও গভীর করে তোলে। জীবনে অনেক মানুষ থাকলে আরও নতুন নতুন মানুষের সাথে পরিচয় হয় এবং আনন্দের মুহূর্ত তৈরি হয়।
২) আইডিয়া তৈরি হয়
নতুন নতুন আইডিয়া মানে আপনি প্রফেশনালি আরও গ্রো করবেন এবং নতুন নতুন জিনিস শিখবেন ও জানবেন। অন্যরা তাদের কোম্পনাইতে কী করছে সেটা জানলে বা বুঝলেও আপনি নতুন নতুন টেকনোলজি বা স্কিলের প্রতি আগ্রহী হয়ে উঠবেন। আপনি যত ছোট ব্যবসাই করুন বা বড় কোম্পানিতে চাকরি করুন, আপনার আইডিয়া আপনাকে বর্তমান দায়িত্ব সফলভাবে পূরণ করতে সাহায্য করবে।
৩) প্রফেশনাল লেভেলে বিভিন্ন ব্যক্তিদের সাথে দেখা হয়
অনেক প্রতিষ্ঠানে উঁচু লেভেল পর্যন্ত পৌঁছানো কঠিন হতে পারে। ঠিক এখানেই নেটওয়ার্কিং এক্সপেরিয়েন্সড প্রফেশনালদের সাথে পরিচয় করিয়ে দিতে পারে। সেই সমস্ত ব্যক্তিদের সাথে পরিচিত হয়ে তাদের ক্যারিয়ার সংক্রান্ত পরামর্শ নিয়ে সামনে এগিয়ে গেলে ভবিষ্যতে আরও সফল হতে পারবেন।
৪) আত্মবিশ্বাস বাড়ে
যে সকল ব্যক্তিরা লজ্জা পান বা ইন্ট্রোভার্ট হন, তাদের জন্য প্রফেশনাল নেটওয়ার্কিং এক ধরনের এক্সারসাইজ। এ কারণে অনেকেই এই ব্যাপারটি এড়িয়ে চলেন। বরং আপনি যখন নতুন বন্ধুর সাথে নিজের আগ্রহের কথা শেয়ার করবেন তখন বুঝতে পারবেন নেটওয়ার্কিং এতটা খারাপও নয়। ক্যারিয়ার নেটওয়ার্কিং ইভেন্টগুলো আত্মবিশ্বাস বাড়ানোর জন্য দারুণ একটি জায়গা। নিজেকে সেসব জায়গায় উপস্থাপন করুন এবং আপনার জন্য যা যা ম্যাটার করে সেগুলো নিয়ে কথা বলুন।
নেটওয়ার্কিং ইভেন্ট কীভাবে খুঁজে পাবেন?
১) বন্ধু বা কলিগদের সাথে কথা বলুন
ওয়ার্ড অব মাউথ এর পাওয়ারকে কখনো ছোট করে দেখবেন না। অনেক কলিগের কাছেই ইন্ড্রাস্ট্রি ফোকাসড নেটওয়ার্কিং ইভেন্টের খবর থাকে। আপনার প্রতিষ্ঠানে কাজ না করেও অনেক বন্ধু ইন্ড্রাস্ট্রি সম্পর্কে তথ্য দিতে পারে। কোনো সহকর্মী বা বন্ধুকে জিজ্ঞেস করুন তারা সামনে কোনো প্রফেশনাল ইভেন্টে অংশগ্রহণ করার কথা ভাবছে কিনা বা আগে যেয়ে ভালো লেগেছে এমন কোনো ইভেন্তের কথা জানাতে পারবে কিনা। এগুলো হতে পারে যে কোনো ব্রেকফাস্ট ডিসকাশন বা নেটওয়ার্কিং ইভেন্ট, হ্যাপি আওয়ার ইভেন্ট, কনফারেন্স, রাউন্ডতেবিল, লেকচার ও ডিসকাশন, ক্লাস এবং এমন অনেক কিছু। আপনার মেন্টররাও কিন্তু খুব ভালো সোর্স হতে পারে এক্ষেত্রে।
২) নেটওয়ার্কিং সাইটগুলো ব্রাউজ করুন
ইন্টারনেটের মাধ্যমে অনেক ইভেন্ট, কনফারেন্স বা নেটওয়ার্কিং ফোকাসড ইভেন্ট এর খোঁজ পেতে পারেন। জিওগ্রাফিক লোকেশন অনুযায়ী নেটওয়ার্কিং সাইটগুলো ভিজিট করুন নিয়মিত।
৩) অ্যালামনাই
আপনার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ইভেন্টের জন্য খুব ভালো একটি সোর্স হতে পারে। কোনো পার্টি বা অনুষ্ঠানে যেয়ে আপনি আপনার বিজনেস কার্ড শেয়ার করতে পারেন বা আইডিয়া জানাতে পারেন। তাছাড়া বিভিন্ন গ্রুপেও জয়েন করতে পারেন।
৪) সোশ্যাল মিডিয়া ও ইনবক্স চেক করুন
আপনি কি সোস্যাল মিডিয়ায় (টুইটার, ফেইসবুক, লিংকড ইন, ইন্সটাগ্রাম) থাকা ইন্ড্রাস্ট্রি অর্গানাইজেশনগুলো ফলো করেন বা নিউজলেটার সাবস্ক্রাইব করেন? অনেক প্রতিষ্ঠান কিন্তু অ্যানুয়াল বা সচরাচর হওয়া বিভিন্ন ইভেন্টের খবর জানায়। এ ধরনের অর্গানাইজেশনগুলোর খবর রাখুন এবং তাদের সোশ্যাল মিডিয়ায় ফলো করুন। যদি আপনার ধারণা না থাকে প্রতিষ্ঠানগুলো কত বড় হয় তাহলে কলিগদের জিজ্ঞাসা করুন, লিংকড ইন এ পোস করুন বা অনলাইনে সার্চ দিন।
৫) লোকাল অর্গানাইজেশন
বিভিন্ন জায়গায় নেটওয়ার্কিং ইভেন্ট খুঁজতে যাওয়ার আগে নিজ এলাকার লাইব্রেরি বা ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলোতে ইভেন্ট হয় কিনা খোঁজ নিতে পারেন। তাছাড়া বিভিন্ন কম্যুনিটি অর্গানাইজেশন, কো ওয়ার্কিং স্পেস বা মার্কেটের মাধ্যমেও ইভেন্টের খোঁজ পাওয়া যায়।
ক্যারিয়ার নেটওয়ার্কিং এমন একটি বিষয় যেটির মাধ্যমে কর্মজীবী যে কোনো ব্যক্তি দ্রুত সফলতার চূড়ায় পৌঁছাতে পারে। তাই জীবনে সফল হতে গেলে নেটওয়ার্কিং শিখতে ও জানতে হবে।