এখনকার দ্রুতগতির দুনিয়ায় পরিবর্তনের সাথে মানিয়ে নিতে নিতে আমরা প্রায়ই দিশেহারা হয়ে যাই। ট্রেন্ড আসা যাওয়ার সাথে সাথে আসা যাওয়া বেড়ে যায় ভোগ্যপণ্যের। টেকনোলজির দ্রুতগতি ও ফাস্ট ফ্যাশনের যুগে জিনিসপত্র কেনা যেন নেশায় পরিণত হয়েছে। এক ট্রেন্ড শেষ হতে না হতেই আরেক ট্রেন্ড শুরু, হাতের এক দেড় বছর আগে কেনা ফোন ফেলে দিয়ে নতুন এডিশনের ফোন কেনা। এর মধ্যে অপচয় এবং আবর্জনা কতটা বেড়ে যাচ্ছে, গ্লোবাল ওয়ার্মিং এর উপর কীভাবে প্রভাব ফেলছে, কখনো ভেবে দেখেছেন কি? এই ট্রেন্ডিনেস ও ফাস্ট ফ্যাশনের সাথে পাল্লা দিয়ে দ্রুতগতিতে বাড়ছে আবর্জনা ও অপচয়ের হার। কখনো কি আমরা ভেবে দেখেছি, এই একবার দুইবার ব্যবহার করে ফেলে দেয়া জিনিসপত্রগুলো দিনশেষে কোথায় যায়? দেখে নেয়া যাক স্টাডি কী বলে।
১) প্রতি বছর উৎপাদিত ১০০ বিলিয়ন টন কাপড়ের মধ্যে ৯২ মিলিয়ন টন কাপড় বর্জ্য হিসেবে উৎপন্ন হয়। তার মানে হচ্ছে বিশ্ব প্রতি সেকেন্ডেই কোথাও না কোথাও কাপড়ের ট্রাক বর্জ্য হিসেবে ল্যান্ডফিলে চলে যাচ্ছে। এবং এমন যদি চলতে থাকে, ফাস্ট ফ্যাশন ওয়েস্ট এর কারণে এ সংখ্যা এই দশকের শেষের দিকে বছরে ১৩৪ মিলিয়ন টন হয়ে দাঁড়াবে।
২) পোশাক ইন্ডাস্ট্রি থেকে উৎপন্ন কার্বন এমিশন ২০৩০ এর শেষের দিকে ৫০% বৃদ্ধি পাবে, যদি এখনই এ ব্যাপারে ব্যবস্থা না নেয়া হয়।
৩) ইউএসএর সাধারণ ক্রেতারা বছরে প্রায় ৮১.৫ পাউন্ড জামা কাপড় ফেলে দেয়। এর ফলে শুধুমাত্র আমেরিকাতেই প্রতিবছর প্রায় ১১.৩ মিলিয়ন টন পোশাক বর্জ্য উৎপন্ন হয়। জেনে রাখা ভালো যে এই পোশাক মোট উৎপাদিত পোশাকের সংখ্যার প্রায় ৮৫%।
৪) কোনো নতুন পোশাক ব্যবহারের সময়ের হার গত ১৫ বছরে প্রায় ৩৬% কমে গিয়েছে। এর মানে হচ্ছে গড়ে বেশিরভাগ পোশাকই কেবলমাত্র ৭ থেকে ১০ বার ব্যবহারের পরেই ফেলে দেওয়া হয়।
৫) বিশ্বের ২০% পানির অপচয়ের জন্য ফ্যাশন ইন্ডাস্ট্রি দায়ী। কাপড় ডায়িং, ফিনিশিং ও রংয়ের জন্য ব্যবহার করা কেমিক্যাল সারা বিশ্বের ২০% পানিদূষণ এবং ৩ পার্সেন্ট কার্বন ডাই-অক্সাইড উৎপন্নের জন্য দায়ী। সুতা তৈরি থেকে শুরু করে কাপড় উৎপাদন এই দুটি প্রসেসে সারা বিশ্বের সবচাইতে বেশি শক্তি ও সম্পদ খরচ হয়।
৬) এক কেজি সুতা তৈরিতে প্রায় ২০ হাজার লিটার পানির প্রয়োজন হয়। তার মানে শুধু দূষণ নয়, ফার্স্ট ফ্যাশনের কারণে অপচয় হচ্ছে খাওয়ার যোগ্য পানিও। যেটা হিসাব করলে এসে দাঁড়ায় শুধুমাত্র একটা টি-শার্ট তৈরিতে প্রয়োজন হচ্ছে ২৭০০ লিটার পরিষ্কার পানি, যা দিয়ে একজন পূর্ণবয়স্ক মানুষ প্রায় ৯০০ দিন বেঁচে থাকতে পারে। এছাড়াও ওয়াশিং মেশিনের কেবলমাত্র এক ওয়াশিং সাইকেলে ৫০ থেকে ৬০ লিটার পানি খরচ হয়।
৭) প্রতিবছর রিসাইকেল না করা এবং অল্প ব্যবহার করেই ফেলে দেওয়ার কারণে প্রায় ৫০০ বিলিয়ন ডলারের ক্ষতি হয়। সারা বিশ্বের হিসাব করতে গেলে, কাপড় ও এ সংক্রান্ত ম্যাটেরিয়াল এর শুধুমাত্র ১২ পার্সেন্টই রিসাইকেল পর্যন্ত যেতে পারে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে আমরা যেসব পোশাক ব্যবহার করি দ্রুত বিভিন্ন ধরনের সুতা, প্লাস্টিক, অন্য মেটারিয়াল এর ফিলামেন্ট, বিভিন্ন অ্যাক্সেসরিজ ইত্যাদি থাকায় তার বেশিরভাগ অংশই রিসাইকেল করা সম্ভব হয় না, কারণ রিসাইকেল করে এসব আলাদা করার মতো টেকনোলজি এখনো খুব অ্যাভেইলেবল নয়।
৮) প্রতিবছর সমুদ্রের যে পরিমাণে মাইক্রোপ্লাস্টিক মিশে যায় তার ১০% আসে টেক্সটাইল ইন্ডাস্ট্রি থেকে। নাইলন ও পলিস্টারের কাপড় দামে কম ও অনেকদিন টেকায় আমরা অনেক বেশি ব্যবহার করি। দাম কম হওয়ায় দু একবার ব্যবহার করে ফেলে দেওয়ার সময় ও দ্বিতীয়বার ভাবতে হয় না। এ ধরনের কাপড় প্রতিবার ধোয়া ও শুকানোর প্রসেসের পর তা থেকে মাইক্রো প্লাস্টিক নির্গত হয়, যা পানির মাধ্যমে সুয়ারেজ সিস্টেমে এবং পরে সমুদ্রে মিশে যায়। এই প্লাস্টিক দূষণ প্রায় ৫০ বিলিয়ন বোতলের প্লাস্টিক দূষণের সমান।
৯) ফাস্ট ফ্যাশন ব্র্যান্ডগুলোর বদৌলতে বর্তমানে ২০০০ সালের তুলনায় প্রায় দ্বিগুণ পরিমাণে কাপড় উৎপন্ন হচ্ছে। এর কারণে প্রোডাকশনের আগের ও পরের অপচয় ও দূষণও বেড়ে গেছে। কাপড়ের কাটা ও সেলাইয়ের কারণে যেসব অতিরিক্ত কাপড় থেকে যায় টুকরো হিসেবে সেগুলো আর কখনোই ব্যবহার করা হয় না। একটি গবেষণায় দেখা যায়, গার্মেন্ট ম্যানুফ্যাকচারের ব্যবহৃত ১৫% কাপড়ই অপচয় হয়।
১০) বড় বড় ফ্যাশন ব্র্যান্ডগুলো তাদের জিনিসের চাহিদা টিকিয়ে রাখতে অতিরিক্ত প্রোডাকশন নষ্ট করে ফেলে। শুধুমাত্র ফাস্ট ফ্যাশন ব্র্যান্ডগুলোই নয় বড় বড় এবং এক্সপেন্সিভ ব্র্যান্ডগুলো এই অপচয় এর জন্য সমানভাবে দায়ী। মূলত, চাহিদা বজায় রাখা, অতিরিক্ত স্টক অন্য ভেন্ডরদের হাতে না পড়তে দেওয়া, ট্যাক্স ফাঁকি দেওয়া এসব কারণে বড় বড় লাক্সারি ব্র্যান্ডগুলোর বিরুদ্ধে অপচয় এবং পণ্য নষ্টের অভিযোগ পাওয়া যায়।
বিভিন্ন ধরনের ফ্যাশন ওয়েস্ট
এখন আমরা কথা বলব ফ্যাশন ইন্ডাস্ট্রি থেকে কী কী আবর্জনা উৎপন্ন হয় তা নিয়ে।
১) ম্যানুফ্যাকচারিং ওয়েস্ট: ম্যানুফ্যাকচারিং ওয়েস্ট মূলত সেই ধরনের বর্জ্য যেগুলো কারখানায় কাপড় তৈরির সময় উৎপন্ন হয়। সাধারণত ডিফেক্টেড ও কাটা টুকরোগুলো ম্যানুফ্যাকচার ওয়েস্ট হিসেবে গণ্য করা হয়। এ ধরনের বর্জ্য রিসাইকেল অথবা রিপারপাস করতে তেমন অসুবিধা হয় না।
২) ক্লথিং ওয়েস্ট: ক্লথিং ওয়েস্ট মূলত পোশাক তৈরি হয়ে যাবার পরে যখন সেটাকে বর্জ্যের কাতারে ফেলে দেওয়া হয়। সেলাইয়ে ভুল, ভুল রঙের সুতা ব্যবহার, কাপড়ে কোথাও ছিদ্র হয়ে যাওয়া, এমনকি ভুল রঙের বোতাম লাগানোর কারণে ও পোশাককে ফেলে দেওয়া হয় বাতিলের খাতায় এবং সেগুলো জায়গা করে নেয় ল্যান্ড ফিলে।
৩) প্যাকেজিং ওয়েস্ট: একটা কথা না বললেই নয় যে, প্লাস্টিক বর্তমানে আমাদের পরিবেশের বিরুদ্ধে বেশ বড় একটি সমস্যা। আর এ প্লাস্টিকের একটা বড় অংশই ব্যবহৃত হয় প্যাকেজিংয়ের ক্ষেত্রে। প্লাস্টিক পরিবেশের সাথে মিশে যায় না, বছরের পর বছর ইকো সিস্টেমে থাকে, যার ফলে মূলত সমুদ্র সবচেয়ে বেশি দূষিত হয়।
৪) টক্সিক বা কেমিক্যাল ওয়েস্ট: সুতা উৎপাদন থেকে শুরু করে একটি পোশাক তৈরি হয়ে শেষ হওয়া পর্যন্ত এটা বিভিন্ন রকমের রঙ, কেমিক্যাল, অ্যাসিড ও গ্রাম জাতীয় পণ্য ব্যবহার করা হয়। যেগুলো ব্যবহারের পর পানির সাথে মিশে গিয়ে পরিবেশে ছড়িয়ে পড়ে এবং ভয়ংকর ক্ষতি করে। এ ধরনের ওয়েস্টই মূলত টক্সিক ওয়েস্ট। টক্সিক ওয়েস্ট খুব দ্রুত ইকো সিস্টেমের সমস্যা করে এবং সরাসরি আমাদের খাদ্যের উৎস দূষিত করে দেয়।
৫) ইলেকট্রনিক ওয়েস্ট: ফাস্ট ফ্যাশনের আরেকটা উল্লেখযোগ্য দিক হচ্ছে ইলেকট্রনিক্স। কীভাবে? প্রায় প্রতি বছরই ইলেকট্রনিক্স এর দিক থেকে আসে নতুন নতুন ট্রেন্ড। সামান্য একটা ফিচার যোগ করে নতুন এডিশনের ক্যামেরা, মোবাইল, কম্পিউটার, সামান্য একটু পরিবর্তন এনে রাইভাল কোম্পানিগুলোর পাল্লা দিয়ে একই জিনিস নতুন নামে বাজারজাত করা, এবং ট্রেন্ডের সাথে গা ভাসিয়ে দিয়ে মাত্র এক দেড় বছর ব্যবহার করা ডিভাইসটিকে ফেলে দিয়ে নতুন এডিশনের নতুন ডিভাইস নিয়ে নেওয়া, এটা ইলেকট্রনিক ওয়েস্ট বেড়ে যাবার একটা বড় কারণ। ইলেকট্রনিক ওয়েস্টের কারণে কার্বন ফুটপ্রিন্ট খুব দ্রুত বাড়ে। ইলেকট্রনিক ওয়েস্ট রিসাইকেল করার পদ্ধতি বেশ সময় ও খরচ সাপেক্ষ হওয়ায়, বেশিরভাগই ওয়েস্টই ল্যান্ড ফিলে জমা হয়ে পরিবেশে থেকে যায়।
৬) এনার্জি ওয়েস্ট: আমাদের প্রাকৃতিক সম্পদের উৎস সীমিত। এর একটা বড় অংশই চলে যাচ্ছে শিল্পায়নের পেছনে। প্রচুর পরিমাণে প্রাকৃতিক সম্পদ ও এনার্জি ব্যবহার হচ্ছে, আর তার বেশিরভাগই হচ্ছে অপচয়। যেকোনো কিছু তৈরিতে পানির ব্যবহার, গাছ কাটা, প্রাকৃতিক খনিজ ব্যবহারের কারণে অপচয়ের মাত্রা বেড়ে যায়।
ফাস্ট ফ্যাশনের যুগে সাসটেইনেবলিটি
এতক্ষণ আমরা যেসব অপচয় এবং তার বিভিন্ন ক্ষতি সম্পর্কে জানলাম, এসব কীভাবে কমানো যায়? হয়তো বড় স্কেলে অনেক কিছুই করা সম্ভব নয়। কিন্তু আমরা নিজেদের জায়গা থেকে নিতে পারি ছোট ছোট পদক্ষেপ। আমরা যদি একটু সচেতন হই এবং নিজেদের জায়গা থেকে ছোট ছোট কিছু পদক্ষেপ নিই, সেটাই একদিন দাঁড়াতে পারে বড় কোনো পরিবর্তনের কারণ হিসেবে।
সাসটেইনেবিলিটি বা স্থায়িত্ব হচ্ছে কোনো একটা প্রসেস দীর্ঘ সময় পর্যন্ত বজায় রাখা। সোজা কথায়, যেকোনো কিছুর স্থায়িত্ব একটা বড় সময় পর্যন্ত ঠিক এবং ব্যবহারযোগ্য রাখাকেই আমরা সাসটেইনেবিলিটি বলতে পারি। সাসটেইনেবল লিভিং এর মধ্যে আমাদের কার্বন ফুটপ্রিন্ট কমানো, পরিবেশের জন্য ক্ষতি হয় এমন কিছু না করা, অপচয় কমানো, দূষণ কমানো, এবং আমাদের কাজের প্রতিক্রিয়া কী হচ্ছে সে ব্যাপারে খেয়াল রাখা এসব কিছুই পড়ে।
সাসটেইনেবলিটি কীভাবে অপচয় ও দূষণ রোধে ভূমিকা রাখে?
সাসটেইনেবলিটির মূল লক্ষ্যই হচ্ছে, দীর্ঘ সময় ক্ষতি না করে টিকে থাকে এমন সব পথ অবলম্বন করা। তাই অপচয় ও দূষণ রোধে এর একটা বেশ বড় ভূমিকা রয়েছে। বর্তমানে বিশ্বে অপচয় ও দূষণ একটি বেশ বড় সমস্যা। একে কমাতে সাসটেইনেবলিটির বিকল্প আসলে নেই। আমাদের যে সকল পদক্ষেপ অপচয় ও দূষণ রোধে ভূমিকা রাখতে পারে, তা সম্পর্কেই আমরা এখন আলোচনা করব।
১) ফাস্ট ফ্যাশন বর্জন করা
ফাস্ট ফ্যাশনের কারণে আমরা ট্রেন্ডি থাকার জন্য অল্প দামে লো কোয়ালিটির পোশাক কিনি, এবং কয়েকবার ব্যবহারের পরেই সেটাকে ফেলে দিই। এ কারণে ফাস্ট ফ্যাশন বর্জন করে আমরা লো ফ্যাশনের দিকে এগোতে পারি। স্লো ফ্যাশন ভালো কোয়ালিটির কম পোশাক কেনাকে প্রমোট করে, যেগুলো টিকেও বেশি দিন। তাই খারাপ কোয়ালিটির কয়েকটা পোশাক না কিনে বরং ভালো কোয়ালিটির, ভালো মানের কাপড়ের তৈরি পোশাক কিনলে সেটাকে ব্যবহারও করা যাবে বেশিদিন। এক্ষেত্রে ক্লাসিক স্টাইল এবং বিভিন্ন স্টাইল এর সাথে মিক্স এন্ড ম্যাচ করে ব্যবহার করা যায় এমন পোশাক কিনলে তা টিকবেও বেশি দিন, আর একটা পোশাকেই ভিন্ন ভিন্ন লুকে ব্যবহার করা যাবে।
২) প্রাকৃতিক ও অর্গানিক ম্যাটেরিয়ালের প্রোডাক্ট কিনা
ফাস্ট ফ্যাশনের কারণে নাইলন, পলিয়েস্টার, প্লাস্টিক থেকে বানানো নকল সিল্ক এ ধরনের ম্যাটেরিয়াল ব্যবহার বেড়ে গিয়েছে। এ ধরনের পোশাক শুধুমাত্র যে পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর তা নয়, এগুলো ব্যবহারের ফলে আমরাও সরাসরি গ্রহণ করে নিচ্ছি মাইক্রোপ্লাস্টিক। যা আমাদের শরীরে থেকে যাচ্ছে এবং ক্যান্সারের মতো বিভিন্ন ভয়াবহ অসুস্থতার কারণ হচ্ছে। তাই এ ধরনের কাপড় না কিনে তার বদলে আমরা প্রাকৃতিক তন্তুর কাপড় ব্যবহার করতে পারি। যেমন- অর্গানিক সুতি কটন, লিলেন, জুটকটন, শিমুল ও বাঁশের তৈরি সুতা ইত্যাদি। এ ধরনের সুতাগুলো ন্যাচারাল ও বায়োডিগ্রেডেবল হওয়ায়, ব্যবহারে নষ্ট হওয়ার পর ফেলে দিলেও পরিবেশের ক্ষতি না করে মিশে যায়। এ কারণে প্লাস্টিক পার্টিকেল ব্যবহার করা কাপড়ের তুলনায় এগুলো পরিবেশের জন্য অনেক কম ক্ষতিকর।
৩) সাসটেইনেবল ও ইথিক্যাল ব্র্যান্ডগুলোকে সাপোর্ট করা
আমরা একটু চোখ কান খোলা রাখলেই আশেপাশেই দেখতে পাব, অনেকেই এই ফাস্ট ফ্যাশন এবং এর দ্বারা হওয়া পরিবেশের ক্ষতির বিরুদ্ধে নিচ থেকে কিছু পদক্ষেপ নিয়েছে। যার মধ্যে একটি হচ্ছে সাসটেইনেবল ও ইথিক্যাল ফ্যাশন। তবে এ ধরনের বেশিরভাগ ব্র্যান্ডগুলো বেশি বাজেট এবং বড় পরিসরে প্রোডাকশন না থাকায় ধরনের ব্র্যান্ডগুলো প্রায়ই নিরুৎসাহিত হয়। আমাদের উচিত, যেসব ব্র্যান্ড এ ধরনের ইকোফ্রেন্ডলি ও সাসটেইনেবল ব্র্যান্ডগুলোকে উৎসাহিত করা এবং এ ধরনের উদ্যোগগুলোকে সাপোর্ট করা। অনেক ফ্রেন্ডলি এখন অর্গানিক এবং ন্যাচারাল ম্যাটেরিয়ালের পোশাক কসমেটিক ইত্যাদি প্রোডাকশন করে। উদাহরণ হিসেবে কালারস, প্যারামাউন্ট টেক্সটাইল, বেঙ্গল ইন্ডিগো এসব ব্র্যান্ডের নাম বলা যায়। এছাড়াও পাট বাস ও কাঠের তৈরি আইটেম, মাটির তৈজসপত্র ও থালা-বাসন, কাঁসা ও পিতলের তৈজসপত্র, ইকো পেন অথবা কাগজের কলম সমস্ত জিনিসও ইকো ফুটপ্রিন্ট কমাতে ভূমিকা রাখে। এছাড়াও যেসব ব্র্যান্ডের সাপ্লাই চেইনে ট্রান্সপারেন্সি থাকে, সেসব ব্র্যান্ডকে ভরসা করা যায়।
৪) কেনাকাটার ক্ষেত্রে সচেতন হওয়া
বর্তমানে কনজুমারিজমের যুগে কেনাকাটার ক্ষেত্রে আমরা অনেক অসচেতন হয়ে গিয়েছি। ব্র্যান্ডগুলোর মার্কেটিং পলিসি এমন যে, বিভিন্নভাবে আমাদেরকে আরো বেশি প্রোডাক্ট কিনতে এবং ব্যবহার করতে উৎসাহিত করা হয়। এক্ষেত্রে আমাদেরই সচেতন হতে হবে। কোনো কিছু কেনার আগে অবশ্যই ভালোভাবে চিন্তা করে নিতে হবে, একটা জিনিসটি সম্পর্কে জেনে নিতে হবে এবং জিনিসটা আমার আসলেই প্রয়োজন কিনা এ ব্যাপারে ভাবতে হবে। সাসটেইনেবিলিটির সাথে মিনিমালিজম এর বেশ গভীর সম্পর্ক রয়েছে। মিনিমালিজম হচ্ছে, শুধুমাত্র একান্ত প্রয়োজনীয় জিনিসগুলো নিয়ে বাঁচার চেষ্টা করা এবং প্রয়োজনের অতিরিক্ত কিছু কখনোই না কেনা। মিনিমালিজম কার্বন ফুটপ্রিন্ট কমাতে বেশ ভূমিকা রাখে।
এছাড়াও কিছু কেনার আগে অবশ্যই যাচাই করে নিতে হবে এবং শুধুমাত্র ইচ্ছার উপর ভিত্তি করে ব্যবহারের অযোগ্য জিনিস কেনা যাবে না।
৫) জিনিসপত্রের ব্যবহারযোগ্যতা বাড়ানো
শুনতে কঠিন হলেও এটা তেমন কিছুই নয় শুধুমাত্র নিজের যেসব জিনিসপত্র আছে সেগুলোর ভালোভাবে যত্ন নেওয়া এবং ভালো অবস্থায় রাখার কথা বলা হয়েছে। আমরা যেসব পোশাক ব্যবহার করি, একটু যত্নেই কিন্তু সেগুলো ব্যবহার করা যায় বহুদিন। নিয়ম মত ধুয়ে শুকানো, সতর্কতার সাথে রাখা, খুব কড়া ডিটারজেন্ট বা অ্যাসিড ব্যবহার না করার মাধ্যমে কাপড়চোপড় এর সেলস লাইফ বাড়ানো যায়। সামান্য একটু ছেঁড়া কাটা বা রংয়ের কারণে কাপড় চোপড় ফেলে না দিয়ে, সেগুলোকে একটু সেলাই করে জুড়ে বা রঙ করে নেওয়া যায়। আমাদের নিশ্চয়ই মনে আছে ছোটবেলায় আমাদের মা দাদুদের কাছে সেলাইয়ের বাক্স থাকতো। তাতে থাকতো হরেক রকম সুতা, বোতাম, লেস ইত্যাদি। সামান্য একটু খুঁতে কাপড় ফেলে না দিয়ে, তারা সেগুলোতে সুতা বোতাম ও লেস বসিয়ে সেটাকে অন্যরকম ডিজাইন দিতে পারতেন। এই একই অভ্যাস আমরাও করতে পারি। এছাড়াও পুরনো কাপড় থেকে নতুন জিনিস, যেমন ব্যাগ, অ্যাপ্লিক, প্রাপ্তের বিভিন্ন জিনিসপত্র ইত্যাদি বানিয়েও কাপড়ের সর্বোচ্চ ব্যবহার নিশ্চিত করা যায়। একে বলা হয় আপসাইকেলিং।
৬) ডিক্লাটার ও থ্রিফটিং
আমাদের মধ্যে অনেকেই ডিক্লাটার ও থ্রিফটিং এর কথা শুনলে নাক কুঁচকান। কিন্তু ফ্যাশন ওয়েস্ট কমাতে এটা বেশ বড় ভূমিকা পালন করে। আপনার ভালো কোয়ালিটির কিন্তু ব্যবহার করবেন না এমন পোশাক ফেলে না দিয়ে কাউকে ডিক্লাটার করে দিতে পারেন। এর ফলে, আপনার এককালের পছন্দের পোশাক নতুন ঘর পায় এবং সেটির সর্বোচ্চ ব্যবহার নিশ্চিত হয়। নতুন প্রোডাকশনের চাহিদাও এতে কমে আসে। ডিক্লাটার ও থ্রিফটিং এ লজ্জার কোনো ব্যাপার নেই, বরং এটি ইকো ফ্রেন্ডলি, খরচ কমায় এবং অপচয় কমায়। এছাড়াও মাঝেমধ্যে থ্রিফটিং এর মাধ্যমে পেয়ে যেতে পারেন পছন্দের নতুন জিনিস প্রায় অর্ধেকের চেয়েও কম দামে। একই কথা খাটে ইলেকট্রনিক ডিভাইসের ক্ষেত্রে। অল্প ব্যবহার করে নতুন মডেল নিতে চাওয়ার আগে পুরনো মডেলটি ডিক্লাটার করে দিতে পারেন এমন কারো কাছে যার হয়তো আপনার মডেলটি প্রয়োজন। এতে একটা এক্সট্রা ডিভাইস কেনার প্রয়োজন হবে না, এবং অলরেডি থাকা ডিভাইসের যথাযথ ব্যবহার নিশ্চিত হবে।
৭) নিজের ইলেকট্রনিক ডিভাইসটির যত্ন নেয়া
ইলেকট্রনিক ওয়েস্ট বা ই ওয়েস্ট পরিবেশের জন্য কতটা ক্ষতিকর, তা আমরা আগেই বলেছি। তাই ইলেকট্রনিক ওয়েস্ট কমাতে আমরা বেশ কিছু পদক্ষেপ নিতে পারি, যার মধ্যে একটা হচ্ছে নিজের ডিভাইসের যত্ন নেওয়া। এক দেড় বছরের মধ্যে নতুন ডিভাইস না কিনে আপনার ব্যবহৃত ডিভাইসটির যদি আপনি ঠিক ভাবে যত্ন নেন, তাহলে এটিই চলতে পারে প্রায় ১০ বছর। আপনার ডিভাইসটিকে প্রোটেক্ট করে রাখতে পারেন কেস ও প্রোটেক্টরের সাহায্যে, এবং ছোটখাটো সমস্যা হলে ডিভাইস চেঞ্জ না করে রিপেয়ার করে নিতে পারেন।
৮) নতুন ডিভাইস কেনার ক্ষেত্রে সতর্ক হওয়া
আমরা প্রায়ই দেখি মার্কেটে যে মডেলটি আছে, তার থেকে খুব সামান্য পরিবর্তন করে নতুন একটি মডেল আনা হলেও সবাই সেটি কিনতে ঝাঁপিয়ে পড়ে। এক্ষেত্রে দেখে নিতে হবে নতুন যে ফিচারটি এসেছে সেটি আসলেই খুব জরুরী কিনা। যেমন- ক্যামেরা ফিচার সামান্য একটু ভালো হওয়ার কারণে সম্পূর্ণ নতুন একটি মোবাইল ডিভাইস কিনে নেওয়ার একদমই প্রয়োজন নেই। এখন আমরা সাধারণত একটি ডিভাইস দিয়েই অনেক কাজ করতে পারি, যার আবিষ্কার হয়েছে আমাদের মাল্টিপল ডিভাইস ব্যবহারের প্রয়োজনীয়তা কমানো, এবং এক জায়গায় সব পেয়ে যাবার সুবিধার জন্য। তাই সামান্য একটু পরিবর্তনের জন্যই ডিভাইস চেঞ্জ করা ভালো সিদ্ধান্ত হবে না।
৯) ই ওয়েস্ট ঠিকঠাকভাবে ডিসপোজ করা
ইলেকট্রনিক বর্জ্য সঠিকভাবে ডিসপোজ করা না হলে পরিবেশের জন্য বেশ বড় ক্ষতির কারণ হতে পারে। ইলেকট্রনিক ডিভাইসে ব্যবহার করা হয় বেশ প্রতিক্রিয়াশীল ম্যাটেরিয়াল, যা পরিবেশের সরাসরি ক্ষতিতে ভূমিকা রাখে। তাই আপনার সাধারণ বর্জ্য পদার্থের মত ডাস্টবিনে না ফেলে দিয়ে আপনার আশেপাশে থাকা ই ওয়েস্ট রিসাইকেল প্রোগ্রামের খোঁজ নিন। যেসব জায়গায় সঠিকভাবেই ওয়েস্ট ম্যানেজমেন্ট হয়, সেখানে আপনার ডিভাইস ডিসপোজ করার চেষ্টা করুন। এছাড়াও অনেক ক্ষেত্রে ম্যানুফ্যাকচারার কোম্পানি পুরনো ডিভাইস নেয়ার বদলে নতুন ডিভাইসে অফার অথবা গিফট দিয়ে থাকে, সেসব প্রোগ্রামের খোঁজ নিয়ে আপনার ডিভাইসটি তাদের দিতে পারেন এবং নতুন প্রোডাক্ট ছাড় পেয়ে যেতে পারেন।
অপচয় ও দূষণ রোধ করতে সাসটেইনেবলিটি একটি বেশ বড় পদক্ষেপ। হয়তো এতে করে একদিন এই পৃথিবীর হওয়া ক্ষতি কমে যাবে না অথবা দৃশ্যপট রাতারাতি বদলে যাবে না। কিন্তু নিজেদের জায়গা থেকে এইসব ছোট ছোট পদক্ষেপ যদি আমরা নিই, তাহলে সম্পূর্ণভাবে না হলেও ধীরে ধীরে পৃথিবীর কার্বন ফুটপ্রিন্ট কমে যাবে। আমরা এমন এক পৃথিবীতে বাস করতে চাই, যেখানে পরিবেশ ও মানুষের ক্ষতির হার সবচেয়ে কম হবে। তাই সাসটেইনেবলিটি, ইকো ফ্রেন্ডলি প্র্যাকটিস, এবং কার্বন ফুট প্রিন্ট কমানোর কোনো বিকল্প নেই।