কর্পোরেট ই-লার্নিং | কর্মীদের দক্ষ করে তোলার সহজ উপায়

কর্পোরেট লাইফে একবার ঢুকে গেলেই শেখা বন্ধ হয়ে যায় না। বরং সময়ের সাথে সাথে নতুন নতুন বিভিন্ন বিষয় আপডেটেড হতে থাকে। ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানের উন্নতির জন্য তাই কর্মীদেরকেও শেখার দুয়ার আরও উন্মুক্ত করে দিতে হয়। কিন্তু কর্মক্ষেত্র ছেড়ে অন্য কোনো প্রতিষ্ঠানে যেয়ে শেখার সময় যেমন থাকে না, তেমনই পুরো সপ্তাহ অফিস করার পর ছুটির দিনে নতুন কিছু শেখার জন্য দৌড়াতেও ইচ্ছা করে না। এইসব সমস্যার সমাধানেই চালু করা হয়েছে কর্পোরেট ই-লার্নিং। ভার্চুয়ালি কর্মীদের ট্রেনিং দেয়ার সবচেয়ে ভালো উপায় এটি। এই ট্রেনিং নানাভাবে হতে পারে। যেমন- ওয়ান টু ওয়ান, গ্রুপ ওরিয়েন্টেড, অ্যাপ বেইজড। নির্ভর করে প্রতিষ্ঠানের কোনটি প্রয়োজন তার উপর। কীভাবে এই ই-লার্নিং কর্মীদের জীবন সহজ করে দিয়েছে এবং এর বেনিফিটগুলো কী কী, সেগুলোই আজ আমরা জানব।

কর্পোরেট ই-লার্নিং এর সুবিধা

১) সুবিধামতো সময়ে ট্রেনিং করা

কর্পোরেট ই-লার্নিং এর সবচেয়ে বড় সুবিধা হচ্ছে, শিডিউল নিজের পছন্দমতো বেছে নেয়া যায়। এর মানে হচ্ছে, কর্মী যে কোনো পজিশনে বা লেভেলেই থাকুক না কেন, যে কোনো সময়, যে কোনো জায়গায় বসে শেখা যায়। তাছাড়া কোনো কোর্স কঠিন মনে হলে সেটা আবার রিভিজিট করে মেমোরাইজ করে নেয়া যাবে। ছোট ছোট যে সেশনগুলো আছে সেগুলো ফ্রি টাইমে বসে ঝালিয়েও নেয়া যাবে। আবার ধরুন, কোনো কর্মীর হয়তো কাস্টমারকে নির্দিষ্ট কোনো রুলস সম্পর্কে জানাতে হবে। ঠিক সেই মুহূর্তে সে জাস্ট অনলাইনে চেক করেই সেটি সম্পর্কে কাস্টমারকে জানিয়ে দিল। এতে কর্মী ইনফর্মড ও নলেজেবল থাকলো।

ই-লার্নিং সহজ বলে এর লার্নিং স্টাইলও সহজ। গ্রুপের সাথে একসাথে ট্রেনিং হলে হয়ত ওয়ার্কলোড বেশি হতে পারে, ডেডলাইন মিস হতে পারে বা লার্নিং অ্যাবিলিটি সহজ নাও লাগতে পারে। এককভাবে ট্রেনিং নেয়া গেলে গোল অ্যাচিভ করাও ইজি হয়। অনেকেই স্বাধীনভাবে কাজ করতে পছন্দ করেন, অনেকের সাথে কাজ করতে কমফোর্ট পান না। তাদের জন্য এটা বেশি বেনিফিটেড।

কর্পোরেট ই-লার্নিং

২) ট্রেনিং এর খরচ কমে

কর্পোরেট ট্রেনিং এর সবচেয়ে বড় সুবিধা হচ্ছে- এটির মাধ্যমে খরচ অনেকটাই কমে আসে। একই বিষয়ের অফলাইন ট্রেনিং এর জন্য প্রতিবারই নতুন করে আয়োজন, লজিস্টিক্স, ট্রেইনার ফি, প্রিন্টেড ম্যাটারিয়াল, খাবার এর ব্যবস্থা করতে হয়। এতে খরচ বেড়ে যায়। সেদিক থেকে ই-লার্নিং এ এগুলোর কোনো খরচই লাগে না। অনলাইন প্ল্যাটফর্মে সবার জন্য সবকিছু উন্মুক্ত থাকায় খরচও কম হয়। তবে এককালীন একটা খরচ শুরুতে লাগে। যেমন- ই-লার্নিং প্ল্যাটফর্ম (LMS), কন্টেন্ট ডেভেলপমেন্ট ইত্যাদি। আবার ই-লার্নিং এক্সপার্টদের সহায়তা লাগতে পারে মাঝে মাঝে। তবে রেগুলার বেসিসে ট্রেনিং চালু রাখার অপারেশনাল খরচ চিন্তা করলে, অনলাইন ট্রেনিং অফলাইন ট্রেনিং এর চেয়ে বেশি সাশ্রয়ী হয়।

৩) সময় বাঁচায়

কর্পোরেট ই-লার্নিং এর সবচেয়ে বড় সুবিধা হচ্ছে এটি সময় বাঁচায়। একবার সঠিকভাবে এই ট্রেনিং করাতে পারলে, ভার্চুয়ালি মিটিং এ লার্নিং ম্যাটারিয়ালস ব্যবহারের পরিমাণও কমতে থাকে। এটি কিন্তু একদিক থেকে পরিবেশের জন্যও ভালো। কারণ কাগজের ব্যবহার এখানে কম হচ্ছে। আবার, এই ট্রেনিং এর আরও একটি সুবিধা হচ্ছে, এটির জন্য দূরে কোথাও যেয়ে উপস্থিত হতে হচ্ছে না। এতে কর্মীর সময়ও বাঁচছে, আবার সেন্টারে সময়মতো পৌঁছানো নিয়ে স্ট্রেসও নিতে হচ্ছে না। ব্যস্ত কোনো শিডিউল থাকলে সেই কাজ আগে শেষ করে ট্রেনিং শুরু করতে পারছেন। প্রতিষ্ঠান যদি বড় হতে থাকে অথবা বেশি চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়ে থাকে, তাহলে ই-লার্নিং কর্মীদের স্কিল বাড়াতে খুব ভালো কাজ করে কোনো ধরনের ক্রিটিক্যাল অপারেশনাল টাস্ক ছাড়াই।

৪) পারফরম্যান্স ও প্রোডাক্টিভিটি বাড়ায়

কর্মক্ষেত্রে ই-লার্নিং এর মানে হচ্ছে কর্মীরা সরাসরি বিভিন্ন বিষয় শেখার মাধ্যমে এবং দক্ষতা অর্জনের মাধ্যমে সেগুলো সরাসরি প্রতিদিনের কাজে লাগাতে পারেন। এতে একজন কর্মী দ্রুত যে কোনো চ্যালেঞ্জ দ্রুত নিতে পারেন এবং সম্পন্ন করতে পারেন। যার কারণে সময়ের সাথে সাথে তিনি আরও প্রফেশনাল ও স্কিলড হয়ে ওঠেন। একজন জানাশোনা কর্মীর পারফরম্যান্সই কিন্তু ভালো হয়। কিন্তু এতে বিজনেসের ওভারঅল প্রোডাক্টিভিটি কীভাবে বাড়ে? গতানুগতিক অন্যান্য ট্রেনিং কোর্সের মতই, ই-লার্নিং ম্যাটারিয়ালস প্রতিষ্ঠানের অবস্থা বুঝে সাজানো হয়। এসবের কারণে তারা ইন্ড্রাস্ট্রিতে প্রচলিত বিজনেস টার্মিনোলজি আরও ভালোভাবে বুঝতে পারেন এবং ক্লায়েন্ট ও কলিগের সাথে কথা বলার সময় আরও কনফিডেন্ট হয়ে ওঠেন।

কর্পোরেট ই-লার্নিং এ কর্মীদের প্রোডাক্টিভিটি বাড়ে

৫) ট্রেইনারের উপর নির্ভরশীলতা কমে

এই ট্রেনিং এর আরও একটি উল্লেখযোগ্য সুবিধা হচ্ছে- কর্পোরেট ট্রেইনারের উপর নির্ভরশীলতা অনেকখানি কমে যায়। বার বার একটি নির্দিষ্ট বিষয়ে ট্রেনিং দেয়ার জন্য ট্রেইনার ম্যানেজ করতে হচ্ছে না। এক্ষেত্রে অনলাইন ট্রেনিং এর জন্য যে ম্যাটারিয়ালস লাগবে সেগুলো তৈরি করতে হবে একবারই। এতে খরচ যেমন কমে, তেমনই অফিসের কাজের সময় নষ্ট করতে হয় না। এতে কাজে ব্যাঘাতও ঘটে না।

৬) নতুন কর্মী সহজেই প্রতিষ্ঠান সম্পর্কে জানতে পারে

ধরুন, প্রতিষ্ঠানে নতুন কর্মীকে নিয়োগ দেয়ার পর বা নিয়োগ দেয়ার সময় তাদেরকে বিভিন্ন অনলাইনের মডিউলের এক্সেস দিয়ে দেয়া হলো। এতে প্রতিষ্ঠানের ইতিহাস, কাজের ধরন, অফিস কালচার, সার্ভিস বা প্রোডাক্ট, এথিক্স, কমপ্লায়েন্স ইত্যাদি বিভিন্ন বিষয় নিয়ে তথ্য দেয়া থাকলো। এতে কী হবে? তারা অল্প সময়ের মধ্যেই প্রতিষ্ঠান সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ সব তথ্য পেয়ে যাবে। এতে প্রতিষ্ঠানে যোগ দেয়া বা কাজে আগ্রহী হওয়া সহজ হবে। এগুলোকে আমরা এমপ্লয়ি বেনেফিট বলতেই পারি।

৭) টার্ন ওভার রেট কমে

নানা কারণে কর্মীরা প্রতিষ্ঠান ছেড়ে চলে যেতে পারেন। এর মধ্যে একটি হচ্ছে পর্যাপ্ত ট্রেনিং এর সুযোগ না থাকা। কারণ দিন দিন একটানা একই কাজ করাতে আগ্রহ কমতে থাকে। নতুন কিছু শেখার সুযোগ না থাকলে কর্মীরা কনফিডেন্স হারিয়ে ফেলেন। যেসব প্রতিষ্ঠানে ট্রেনিং এর মাধ্যমে নতুন বিভিন্ন বিষয় শেখার সুযোগ থাকে, সেখানকার কর্মীরা বেশি বিশ্বস্ত হয়ে থাকেন। নিজেদের ক্যারিয়ার নিয়ে উচ্চাকাঙ্ক্ষী হন, দক্ষতা বাড়াতে পারেন, প্রতিষ্ঠান ও কাজের প্রতি মোটিভেটেড থাকেন। এক কথায় তাদের পারফরম্যান্স অনেক ভালো হয়। কর্পোরেট ই-লার্নিং তাদেরকে নিজের দুর্বলতা খুঁজে বের করার সুযোগ করে দেয়। এতে তারা নিজেরা নিজেদের কাজ করতে পারেন, নিজেদের সামর্থ্য বুঝতে পারেন। এতে সবচেয়ে বেশি লাভ হয় প্রতিষ্ঠানেরই। কারণ কর্মীরা আরও দক্ষ হয়ে প্রতিষ্ঠানের উন্নতির জন্য কাজ করতে থাকেন, টার্নওভার রেট অনেক কমে আসে, বাইরের মানুষের কাছে নিজেদের ব্র্যান্ড নিয়ে গর্বের সাথে কথা বলতে পারেন।

কর্পোরেট ই-লার্নিং এ টার্নওভার রেট কমে

৮) নলেজ রিটেনশন বাড়ে

একজন কর্মী যখন ইন্টারেকটিভ ও এংগেজিং এনভায়রনমেন্টে নতুন নতুন বিষয় জানা ও শেখার সুযোগ পায়, তখন সেটা শুধু তার জ্ঞান ও দক্ষতাই বৃদ্ধি করে না, প্রতিষ্ঠানের ভেতর সেই নলেজ ও স্কিল রিটেনশনের সুযোগও বাড়িয়ে দেয়। অনলাইন ট্রেনিং এর আধুনিক সব অ্যাপ্লিকেশন যেমন- ব্লেন্ডেড লার্নিং, সিনারিও অ্যানালাইসিস, স্টোরিস ও গেইম, ইন্টারেক্টিভ অ্যাসেসমেন্ট, মাইক্রো লার্নিং, মোবাইল লার্নিং ইত্যাদির মাধ্যমে সেসব ট্রেনিং আরও ইফেক্টিভ ও লং টার্মের হয়। এক কথায়, প্রতিষ্ঠানের ভেতর সরাসরি এগুলো প্র্যাক্টিক্যালি অ্যাপ্লাই করা যায়।

৯) অ্যামেচার কর্মীদের দক্ষতা বাড়ায়

সব প্রতিষ্ঠানেই কিছু কর্মী থাকেন, যাদের দক্ষতা ও জ্ঞান সীমিত থাকে। তার মানে এই নয় যে, তাদের পক্ষে নতুন কিছু শেখা সম্ভব নয়। অ্যামেচার এমপ্লয়ি, ভলান্টিয়ার, ইন্তার্ন বা পার্ট টাইম কর্মী হায়ার করে তাদেরকে যথাযথ ট্রেনিং দিয়ে যোগ্য করে তোলা সম্ভব। ই-লার্নিং এক্ষেত্রে খুব ভালো একটি অপশন হতে পারে। প্রযুক্তি যত আধুনিক হচ্ছে, তত এসবের জন্য দক্ষ জনবল পাওয়া কঠিন হচ্ছে। তাই যদি কর্পোরেট ই-লার্নিং এর মাধ্যমে কঠিন বিষয়গুলো শেখানো যায়, তাহলে তারা যে কোনো প্রতিষ্ঠানের জন্যই অ্যাসেট হয়ে উঠতে পারেন।

কর্পোরেট লার্নিং কী এবং কীভাবে কর্মীদের জন্য এটি লাভজনক হয়ে উঠতে পারে সেটি সম্পর্কে বেশ কিছু তথ্য আজ শেয়ার করলাম। যেসব প্রতিষ্ঠানে এই লার্নিং শুরু হয়েছে, তারা অলরেডি এর সুফল বুঝতে পারছেন। যারা শিখছেন, তারাও বুঝতে পারছেন নতুন নতুন স্কিল ডেভেলপ করতে পারলে কত আনন্দ হয়। তাই সময়ের সাথে তাল মিলিয়ে চলার জন্য কর্পোরেট ই-লার্নিং প্রসেস যত দ্রুত সম্ভব চালু করুন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *