প্যাসিভ ইনকাম | ঘুমিয়েই আয় করুন নিশ্চিন্তে

“আপনি যদি ঘুমানোর সময়ও অর্থোপার্জনের উপায় খুঁজে না পান, তবে আপনি মৃত্যুর আগ পর্যন্ত কাজ করবেন।” – ওয়ারেন বাফেট। বিশ্বের অন্যতম ধনী ওয়ারেন বাফেটের এই উক্তিটি হুট করে শুনে আপনার মাথায় আসতেই পারে যে,”সে কি! ঘুমিয়ে কীভাবে আয় করা যায়?” যদিও বিষয়টি অবাস্তব বা স্বপ্নের মতো লাগতে পারে, তবে আসলেই ঘুমিয়েও আয় করা যায়। এই ধারণা বা প্রক্রিয়াটিকে প্যাসিভ ইনকাম বলা হয়। চলুন তবে দেরি না করে আজকে আয়ের এই চমৎকার উপায়টি সম্পর্কে জেনে নিই।

প্যাসিভ ইনকাম কী?

আপনার দিবাস্বপ্নকে সত্যি করার মতো একটি ধারণা বা উপায় হলো প্যাসিভ ইনকাম। এই আকর্ষণীয় ধারণাটি মূলত আপনার আর্থিক স্বাধীনতা ও অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতার একটি কৌশলগত পদ্ধতি। প্যাসিভ ইনকাম হলো এমন একটি সিস্টেম বা বিনিয়োগ যেটি থেকে ক্রমাগত লভ্যাংশ আয় করা যায় প্রতিদিন কাজ না করেও। অর্থাৎ স্বল্প পরিশ্রমে বেশি আয় যেখানে আপনার বিনিয়োগকৃত টাকা বা সম্পদ থেকে একা একাই আয় হতে থাকে। এটির মাধ্যমে স্বল্প বিনিয়োগ ও শ্রমে দীর্ঘমেয়াদী সম্পদ তৈরির ভিত্তি গড়া সম্ভব। কোনো সম্পদ ভাড়ায় দেয়া, অথবা সীমিত অংশীদারিত্ব, এমন কোনো ব্যবসা বা প্রকল্প যেখানে আপনাকে প্রতিদিন কাজ করতে হয় না। যদিও এ ধরনের উৎস থেকে উপার্জনের জন্য প্রাথমিকভাবে আপনাকে হয়তো পরিশ্রম করতে হবে বা সময় দিতে হবে, তবে ধীরে ধীরে দেখা যাবে যে এসকল উৎস থেকে কোনো পরিশ্রম বা প্রতিদিনের কাজ ছাড়াই উপার্জন করতে শুরু করেছেন।

প্যাসিভ ইনকামের উপায়

প্যাসিভ ইনকামের ধারণা সম্পর্কে তো জানা হলো, এবার জানা যাক কীভাবে এটি করা সম্ভব। মূলত হাতে থাকা সম্পদ ও মূলধনকে সঠিকভাবে কাজে লাগিয়ে ও সঠিক জায়গায় ইনভেস্ট করে তা থেকে অল্প পরিশ্রমে আরো সম্পদ গঠনই হলো এটির মূল লক্ষ্য। চলুন জেনে নিই প্যাসিভ ইনকামের কিছু সেরা উৎস।

১) রিয়েল এস্টেট

রিয়েল এস্টেট ব্যবসা বর্তমানে বেশ জনপ্রিয় এবং প্যাসিভ ইনকামের একটি ভালো উৎস। রিয়েল এস্টেট বলতে কোনো ভূ-সম্পত্তি, এর উপরে থাকা স্থাপনা, এতে থাকা যাবতীয় প্রাকৃতিক সম্পদ ইত্যাদি অর্থাৎ নির্দিষ্ট মালিকানাধীন সকল বাস্তব সম্পদই হলো রিয়েল এস্টেট। এগুলো পরিবর্তন ও উন্নত করে কেনা, বেচা বা ভাড়া দেয়ার ব্যবসাকেই রিয়েল এস্টেট বলে। উদাহরণস্বরূপ বলা যেতে পারে- ডেভেলপার কোম্পানীগুলোর কথা। যারা কারও জমি নিয়ে সেটিতে বিভিন্ন স্থাপনা নির্মাণ করে সেটি থেকে আয় করে থাকে। অথবা আপনার জমিতে আপনি নিজেই বাড়ি, ফার্মহাউজ, হাসপাতাল, দোকানসহ আয় করা যায় এমন স্থাপনা নির্মাণ করে যদি ভাড়া দেন অথবা কেনাবেচা করেন তাহলে সেটি রিয়েল এস্টেট এর আওতায় পড়ে। এই ব্যবসা শুরু করতে গেলে প্রথমে আপনার হাতে কিছু সম্পদ বা বিনিয়োগের জন্য উৎস থাকতে হবে। সেটিকে তৈরি ও ভালোভাবে পরিচালনা করার জন্য আপনাকে তৈরি থাকতে হবে। এটি আপনি স্বল্প বা দীর্ঘ সময়ের জন্য ভাড়া দিয়ে, আপনার ব্যবসাটি প্রতিষ্ঠিত হলে নির্দিষ্ট হারে ইনকাম করা শুরু করবেন।

প্যাসিভ ইনকাম

 

আপনি যদি রিয়েল এস্টেট ব্যবসাতে আগ্রহী হন, কিন্তু নিজের কোনো সম্পত্তি না থাকে তাহলে বিভিন্ন রিয়েল এস্টেট প্ল্যাটফর্মগুলোকে বিবেচনা করতে পারেন। এ ধরনের প্ল্যাটফর্ম যেকোনো গ্রাহককে একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ বিনিয়োগ করতে দেয়। এর মাধ্যমে বিনিয়োগকারীরা রিয়েল এস্টেটের জন্য বিভিন্ন সম্পত্তি যেমন- কমার্শিয়াল বিল্ডিং, ভাড়া দেয়ার জমি অথবা ডেভেলপমেন্ট প্রজেক্ট নিজেদের জন্য নিতে পারে। প্ল্যাটফর্মগুলো নিজেদের কিছু শেয়ারের পরিবর্তে আপনার এসব এস্টেট বিজনেস সামলায়। ফলে আপনার নিজের এসব সামলানোর কোনো ঝামেলা থাকে না এবং আপনি সহজেই এখান থেকে ইনকাম করতে পারেন।

২) সঞ্চিত অর্থ বিনিয়োগ

আপনার সঞ্চিত অর্থের কিছু অংশ বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিনিয়োগের মাধ্যমেও আপনি প্যাসিভ ইনকামের সুযোগ তৈরি করতে পারেন। এই ক্ষেত্রে আছে অনেকরকম সুযোগ। যেমন- স্টক মার্কেটে বিনিয়োগ, মিউচুয়াল ফান্ড, বন্ড কিংবা পিয়ার লোনিং এর মত বিভিন্ন জায়গায় বিনিয়োগ করতে পারেন। এ ধরনের উৎসগুলোতে সাধারণত ফলোআপ করা ছাড়া তেমন কোনো পরিশ্রম নেই। নির্দিষ্ট সময় ও শর্তের বিপরীতে আপনার এই বিনিয়োগ থেকে আয় করতে শুরু করবেন। স্টক বা শেয়ার মার্কেট শুরুর পর্যায়ের জন্য বেশ ভালো। সাধারণত বড় বড় কোম্পানীগুলো তাদের মূলধন বাড়ানো ও কার্যক্রম চালানোর জন্য নিজেদের কোম্পানীর শেয়ার মার্কেটে বিক্রি করে থাকে। এসব শেয়ার বিনিয়োগকারীরা কিনে থাকেন। কোম্পানীগুলো তাদের লভ্যাংশ প্রত্যেক শেয়ারহোল্ডারকে সমান ভাগে ভাগ করে দেয়। ফলে বলা যায়, বিনা শ্রমে শুধুমাত্র অর্থ বিনিয়োগের মাধ্যমে আয় করার সহজ উপায় এটি।

৩) শিল্প বা শিল্পের বিকল্পগুলোতে বিনিয়োগ

শিল্প বা শিল্পের বিকল্প প্রজেক্টগুলোতে ইনভেস্ট হতে পারে প্যাসিভ আয়ের অন্যতম একটি উৎস। এ ধরনের প্রজেক্টগুলোতে ইনভেস্টরদের তেমন কোনো কাজ থাকে না, শুধুই নিজের ইনভেস্ট থেকে আয় করা ছাড়া। শিল্পকলা বা বিভিন্ন রকম শিল্প হতে পারে সেটা বস্ত্র, আর্ট এমন কি রয়াসনশিল্পেও আপনি ইনভেস্ট করতে পারেন। যদি আপনার নিজের পরিচিত শিল্পে ইনভেস্ট এর মত উৎস না থাকে তবে বিভিন্ন শিল্প নিয়ে কাজ করা কোম্পানীগুলোতে শেয়ার বা স্টক এ বিনিয়োগ করতে পারেন। স্টক মার্কেট বা বন্ডের মত শিল্পে বিনিয়োগও বেশ সুরক্ষিত। এখানে বিনিয়োগ নষ্ট হওয়ার সম্ভাবনা কম থাকে। এছাড়া আপনার পুঁজি অনুযায়ী কোন ধরনের শিল্পে বিনিয়োগ সবচেয়ে ভালো হবে এগুলো জানতে আপনি বিভিন্ন মার্কেটিং এক্সপার্টদের পরামর্শ নিতে পারেন।

৪) অনলাইনে ডিজাইন, আর্ট বা ফটোগ্রাফি বিক্রি

প্যাসিভ ইনকামের আরেকটি মজার উৎস হলো অনলাইন প্ল্যাটফর্মে নিজের আঁকা ছবি, ডিজাইন অথবা নিজের করা ফটোগ্রাফি ইত্যাদি বিক্রি করা। সাধারণত এ ধরনের কাজগুলো আমরা শখের বশেই করে থাকি। বর্তমানে নানারকম অনলাইন প্ল্যাটফর্মে ধরনের ডিজাইন, ফটোগ্রাফ বা আঁকা ছবির ডিজিটাল কপি কিনে থাকে এবং আপনাকে স্বত্ত্ব দিয়ে থাকে। এগুলো বিভিন্ন ক্ষেত্রে নানাভাবে ব্যবহৃত হয়ে থাকে যেমন- ওয়ালপেপার হিসেবে ফটোগ্রাফ, আঁকা ছবি বিভিন্ন সাইট থেকে স্বল্পমূল্যে বিক্রি হয়। আবার ডিজাইনগুলো টি শার্ট, বেডশীট, সিরামিকের জিনিসপত্রসহ নানারকম ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হয়। প্রতি ডাউনলোড বা ব্যবহারে পাওয়া লাভ থেকে কিছু অংশ আপনি পাবেন। তাই এটি বর্তমানে প্যাসিভ ইনকামের ক্ষেত্রে বেশ জনপ্রিয় একটি উৎস।

প্যাসিভ ইনকাম

 

৫) এফিলিয়েট মার্কেটিং

বর্তমানে ডিজিটাল মার্কেটিং এর অন্যতম রূপ- এফিলিয়েট মার্কেটিং বেশ জনপ্রিয় একটি টার্ম। সাথে এটি প্যাসিভ ইনকামের জন্যও বেশ ভালো ও সুপরিচিত। মূলত যেকোনো কোম্পানির প্রোডাক্ট বা সার্ভিস কমিশনের মাধ্যমে প্রমোট ও বিক্রির ব্যবস্থা করাকে এফিলিয়েট মার্কেটিং বলে। ধরুন কোনো একটি ডিজিটাল ফ্রিজ কোম্পানির সাথে আপনি কাজ করছেন। অর্থাৎ তারা অনলাইনের মাধ্যমে পণ্য সরবরাহ করে থাকে। একটি ৫০,০০০ টাকার ফ্রিজ বিক্রি করতে পারলে তারা আপনাকে ১০% লাভ অর্থাৎ ৫০০০ টাকা দিয়ে থাকে। আপনি আপনার পরিচিত সবাইকে সেই কোম্পানি রিকমেন্ড করেন, এছাড়া বিভিন্নভাবে প্রচারের মাধ্যমে কাস্টমার যোগাড় করেন। এক্ষেত্রে আপনি ফোন বা যেকোনো ডিভাইসের মাধ্যমে ঘরে বসেই ইনকাম করতে পারেন। যেহেতু পণ্য স্টোর করা, সরবরাহ, কোনো ক্ষতিপূরণ এগুলো সবই কোম্পানী করে থাকে তাই এ ধরনের মার্কেটিং এ আপনার পরিশ্রম খুবই কম থাকে।

৬) স্থাপনা, যানবাহন ইত্যাদি ভাড়া

প্যাসিভ ইনকামের অন্যতম উপায় হলো বিভিন্ন দ্রব্য, স্থাপনা, যানবাহন ও সেবাসামগ্রী ভাড়ায় প্রদান করা। ধরুন আপনার একটি বড় বাসা আছে, যেখানে খালি একটি রুম আছে, যা কাজে লাগছে না। আপনি এটিকে ভাড়া দিতে পারেন। আবার নিজস্ব জমি বা জায়গায় বাসা, হাসপাতাল, দোকান অথবা কম খরচে গ্যারেজ ইত্যাদি নির্মাণ করে ভাড়া দিতে পারেন। বর্তমানে উবার, পাঠাও কিংবা ফুডপান্ডা, বা নানারকম হোম ডেলিভারি সার্ভিসের জন্য বাইক, প্রাইভেট কার ইত্যাদি ভাড়ায় চালানোর জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি পেয়েছে। এছাড়া রেন্ট-এ-কার, মালামাল পরিবহনের জন্য ট্রাক বা পিক আপ ও ভাড়ায় চালানো যায়। এ ধরনের ব্যবসাতে সাধারণত একটু খেয়াল রাখা ছাড়া খুব একটা পরিশ্রম নেই। তাই প্যাসিভ ইনকামের জন্য এগুলোও বেশ ভালো উপায়।

৭) অনলাইন প্রোডাক্ট অথবা কন্টেন্ট তৈরি

বর্তমানে অনলাইন প্রোডাক্টের মার্কেট বেশ জনপ্রিয়। অনলাইন প্রোডক্ট বলতে যে ধরনের সেবা বা সার্ভিস কাস্টমার অনলাইনে পেতে আগ্রহী হয় তাকেই বোঝায়। হতে পারে এটি একটি ই-বুক, হতে পারে কোনো কোর্স অথবা কোনো অনলাইন ওয়ার্কশপ যেটার স্কিল অডিয়েন্স শিখতে চায়। আবার বিভিন্ন অ্যাপস, সফটওয়্যার, গেমস ইত্যাদিও তৈরির মাধ্যমে আয় করতে পারেন। এসব ক্ষেত্রে একটি শক্তিশালী অডিয়েন্স বেইস তৈরি করাটাই মূল পরিশ্রম। আবার বিভিন্ন প্ল্যাটফর্মে অনলাইন কন্টেন্ট তৈরির মাধ্যমেও আপনি প্যাসিভ ইনকাম করতে পারেন। ইউটিউব, ফেসবুকে ধরনের জনপ্রিয় প্ল্যাটফর্মগুলো কিছু নির্দিষ্ট শর্তের বিনিময়ে আপনার কন্টেন্টের জন্য আপনাকে নিয়মিত পে করবে। একবার শর্ত অনুযায়ী সব ঠিক থাকলে আপনার একটি কন্টেন্টের জন্যও আপনি নিয়মিত আয় করতে পারবেন।

কন্টেন্ট ক্রিয়েট করে প্যাসিভ ইনকাম

শুরুর দিকে অনেক সময় প্যাসিভ ইনকামের জন্য পরিশ্রম ও সময় ব্যয় করা লাগতে পারে। তবে প্যাসিভ ইনকামের উৎস ও সম্ভাবনার পরিধি অনেক বড়। আপনি চাইলেই বিভিন্নভাবে অল্প পরিশ্রমে আয় করতে পারবেন, যা আপনাকে জীবনভর আয় করার মত সুযোগও তৈরি করে দিতে পারে। তাই আপনি সিদ্ধান্ত নেয়ার আগে ভাবুন ঠিক কোন উৎসে বিনিয়োগের মত সম্পদ অথবা অর্থ হাতে আছে। আপনার অব্যবহৃত সম্পদই এক্ষেত্রে হতে পারে আপনার আয়ের বড় উৎস। তাই আপনার পরবর্তী অর্থনৈতিক পরিকল্পনায় প্যাসিভ ইনকামের বিষয়টি মাথায় রাখতেই পারেন।

2 thoughts on “প্যাসিভ ইনকাম | ঘুমিয়েই আয় করুন নিশ্চিন্তে

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *