ইনোভেশন এর অর্থ আমরা সবাই জানি। উদ্ভাবন, নতুন কিছুকে স্বাগত জানানো, নতুনত্বের সৃষ্টি করা। বর্তমান যুগে কোনো কিছুই আর আগের মত স্থায়ী বা বদ্ধ নয়, ধীরে ধীরে সবকিছুতেই আসছে পরিবর্তন। পরিবর্তনের হাত ধরেই আজকে আমাদের আলোচনা ইনোভেটিভ মার্কেটিং নিয়ে। যে কোনো ব্যবসায় অথবা কাজে নতুন কোনো কনসেপ্ট নিয়ে আসা, নতুন কিছু ট্রাই করাটাই হলো ইনোভেটিভ মার্কেটিং। চিরাচরিত যেসব আইডিয়া নিয়ে সবাই কাজ করে, তার থেকে একটু ব্যতিক্রমী কিছু দিয়ে গ্রাহক টানায় ইনোভেটিভ মার্কেটিং এর জুড়ি নেই। এই মার্কেটিং শুধু একটা ট্রেন্ড নয়, এটি একটি কার্যকরী ও নতুন মার্কেটিং সিস্টেম, যাতে আগের চাইতে কম এফোর্ট দিয়ে আরো বেশি সাফল্য লাভ করতে পারবেন আপনিও।
ইনোভেশন মার্কেটিং কেন জরুরি?
মার্কেটিং এ ইনোভেশন শুধুমাত্র টেকনোলজির ব্যবহার নয়, এর সাথে নতুন নতুন আইডিয়ারও সমন্বয়। প্রোডাক্ট ও সার্ভিস ইমপ্রুভ করতে ইনোভেশনের জুড়ি নেই। নতুন নতুন মার্কেট ধরতে ও বিক্রি আর লাভ বাড়াতে ইনোভেশন বেশ কার্যকর।
ইনোভেশন বিজনেসে বিভিন্নভাবে কাজে লাগানো যায়। প্রথমেই সম্পূর্ণ বিজনেস এর আওতায় না নিয়ে একটু একটু করে প্র্যাকটিস বা টেস্ট রান হিসেবে বিজনেসে অ্যাপ্লাই করে দেখা যেতে পারে। এছাড়াও লঞ্চিং, প্রাইসিং, প্রোডাকশন এসবকে ইউনিকভাবে প্রেজেন্ট করেও মার্কেটিং এ ইনোভেশন ঘটানো যায়।
মার্কেটিং ইনোভেশনের কিছু আলাদা ধরন
এখানে তিন ধরনের মার্কেটিং ইনোভেশনকে আমরা বিশ্লেষণ করে দেখতে পারি যা আমাদেরকে মার্কেটিং এ ইনোভেশন এর ক্ষেত্রে আমাদের আরো স্পষ্ট ধারণা দিবে।
১) র্যাডিকেল ইনোভেশন
এই ধরনের পদক্ষেপে ব্র্যান্ডে বেশ বড় রকমের পরিবর্তন আনা হয়, হতে পারে সেটা মার্কেটিং এ বা প্রোডাকশনে। যখন কোনো কোম্পানি তার সম্পূর্ণ কাজকর্মের পদ্ধতি বা প্রোডাক্ট লাইনে বড় কোনো পরিবর্তন আনে, তাকে আমরা র্যাডিকেল ইনোভেশন বলতে পারি। মার্কেটে সেম ধরনের অনেক প্রোডাক্ট থাকলেও, র্যাডিকেল ইনোভেশন একই কাজের জন্য তৈরি প্রোডাক্টকে সম্পূর্ণ অন্যভাবে মার্কেটিং করে বিশেষভাবে প্রেজেন্ট করে।
উদাহরণ হিসেবে আমরা আইফোনের কথা ধরতে পারি। আইফোন যখন মার্কেটে আসে, তখন এন্ড্রয়েড উইন্ডোজ এসব ফোনের জনপ্রিয়তা চরমে। কিন্তু তার নিজস্ব বৈশিষ্ট্য, ছবি তোলার কোয়ালিটি, বিভিন্ন আলাদা অ্যাপ্লিকেশন এসব দিয়ে আইফোন তার নিজস্ব জায়গা ঠিকই করে নেয়। এখন সবাই জানে একটা প্রফেশনাল ক্যামেরার কোয়ালিটির কাজ করতে পারে আপনার আমার হাতের ছোট্ট আইফোন।
২) ইনক্রিমেন্টাল ইনোভেশন
ইনক্রিমেন্টাল ইনোভেশনে সরাসরি প্রোডাক্টে কোনো বিশাল পরিবর্তন আনে না, একটা আগে থেকেই চলতে থাকা প্রোডাক্টে নতুন কোনো ফিচার যোগ করে। সাধারণত, প্রোডাক্ট আগেই মার্কেটে থাকে, তবে সুযোগ সুবিধা বাড়াতে বা গ্রাহকের চাহিদার উপর নির্ভর করে এর সাথে নতুন কিছু যোগ করা হয়। উদাহরণ হিসেবে আমরা গুগলকে দেখতে পারি। গুগলের পথচলা শুরু হয়েছিল সার্চ ইঞ্জিন হিসেবে। এখন জিমেইল, ড্রাইভ, ডক, ক্লাসরুম এসব ছাড়া আমাদের প্রতিদিনকার জীবন কল্পনা করা কষ্টকরই হয়ে পড়ে। ইনক্রিমেন্টাল ইনোভেশন এভাবেই ধীরে ধীরে প্রোডাক্টের গ্রহণযোগ্যতা বাড়ায়।
৩) ডিসরাপ্টিভ ইনোভেশন
এটি মোটামুটি ট্র্যাডিশনাল কোনো একটা সার্ভিস থেকে খুব দ্রুত যুগের সাথে তাল মিলিয়ে এবং টেকনোলজির ব্যবহার করে মার্কেটে নিজেদের স্থান শক্ত করে নেয়। ডিসরাপ্টিভ ইনোভেশন নির্দিষ্ট কাস্টমারদেরকে টার্গেট করে তাদেরকে সবচেয়ে ভালো কাস্টমার সার্ভিস দেওয়ার চেষ্টা করে। বলা যায়, ক্রেতা যাই চান তাকেই তেমনভাবেই প্রেজেন্ট করাই হচ্ছে ডিসরাপ্টিভ ইনোভেশন।
উদাহরণ হিসেবে আমরা নেটফ্লিক্স এর কথা বলতে পারি। নেটফ্লিক্স ছিল একটি বাই-মেইল ডিভিডি রেন্টাল সার্ভিস। প্রযুক্তির উন্নতির সাথে সাথে ডিভিডি এখন জাদুঘরে চলে গেছে। নেটফ্লিক্সও ডিভিডির জায়গায় ওটিটি প্লাটফর্মে চলে এসেছে। বর্তমানে সারাবিশ্বে ২২০ মিলিয়নেরও বেশি মানুষ নেটফ্লিক্সে সাবস্ক্রাইব করেছেন এবং নিয়মিত ব্যবহার করেন।
৪) আর্কিটেকচারাল ইনোভেশন
আর্কিটেকচারাল ইনোভেশন বড় পরিসরে নতুন কিছু করে না, বরং প্রচলিত টেকনোলজির ব্যবহার করে প্রোডাক্টকে নতুন কাস্টমারের কাছে পরিচিত করায়। যেমন- রিব্র্যান্ডিং রিপ্যাকেজিং নতুন ভার্সন ইত্যাদি। উদাহরণ হিসেবে আমরা কম্পিউটারের কথাই বলতে পারি। বিশ্বের প্রথম কম্পিউটারটি ছিল বিশাল বড় আকারের। এটি অপারেট করতে কয়েকজন মানুষের দরকার হতো এবং এটিকে কোথাও নিয়ে যেতে রীতিমতো আলাদা গাড়ির দরকার হতো। এখন প্রযুক্তির উন্নয়নে কম্পিউটার বিভিন্ন আকারে চলে এসেছে, যেমন- ডেক্সটপ, ল্যাপটপ, সম্পূর্ণ টাচ স্ক্রিন কন্ট্রোলড ট্যাব ইত্যাদি। মানুষ ভিন্ন ভিন্ন কাজে এখন ভিন্ন ভিন্ন কম্পিউটার ব্যবহার করে।
মার্কেটিং এ ইনোভেশন এর কয়েকটি স্ট্র্যাটেজি
ইনোভেশন মার্কেটিং আপনি কাজে লাগাতে পারেন নিজের বিজনেসেও। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির অগ্রগতির এই যুগে আপনি পিছিয়ে থাকবেন কেন? জেনে নিন ইনোভেশনের কয়েকটি স্ট্র্যাটেজি, যা বিভিন্ন বড় বড় কোম্পানি সফলভাবে অ্যাপ্লাই করেছে এবং সুফল পেয়েছে।
১) ব্র্যান্ড রিপজিশনিং
বাজারে অলরেডি থাকা একটা ব্র্যান্ডের ইমেজ পুনরুদ্ধারের জন্য রিপজিশনিং হতে পারে চমৎকার একটি উপায়। প্রথমে ব্র্যান্ডের সবল ও দুর্বল জায়গাগুলো, সুযোগ ও সমস্যাগুলো অবশ্যই অ্যানালাইজ করে নিতে হবে। এরপর সেই জ্ঞানকে কাজে লাগিয়ে আপনি আপনার ব্র্যান্ড রিপজিশনিং করতে পারেন। ব্র্যান্ড রিপজিশনিং এর ক্ষেত্রে বিভিন্ন জিনিস চলে আসে, যেমন- ব্র্যান্ডের ম্যাসেজ ও টোন পরিবর্তন, লোগো, অ্যাডভার্টাইজমেন্ট, প্যাকেজিং ইত্যাদি পরিবর্তন, এমনকি ব্র্যান্ডের নাম পরিবর্তনও করা যেতে পারে।
রিপজিশনিং স্ট্র্যাটেজিকে সঠিকভাবে ব্যবহার করতে পারলে আপনি কাস্টমারদের সাথে সাথে নতুন কাস্টমারদের আকৃষ্ট করতে পারবেন এবং ব্যবসার গতি বেড়ে যাবে।
রিপজিশনিং এর একটা ভালো উদাহরণ হল স্পটিফাই। কোভিড নাইন্টিন চলাকালীন সময়ে অন্যান্য অনেক ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের মত স্পটিফাইও তাদের বাজেট কমাতে বাধ্য হয় এবং আগের মত লাভ রাখতে পারেনি। এই ক্ষেত্রে তাই তারা নতুনভাবে প্ল্যানিং করে।
- তারা মার্কেটে প্রচলিত কন্টেন্টের সাথে সাথে নিজেদের অরিজিনাল কন্টেন্ট, যেমন- পডকাস্ট ও অরিজিনালস এর উপর ফোকাস করে।
- তারা আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স, এক্সপার্ট ও সেলিব্রেটিদের সাহায্য নিয়ে বিশেষভাবে ইউজার ফ্রেন্ডলি প্লে লিস্ট তৈরি করেছে যাতে গ্রাহক স্পেশাল ফিল করেছে।
এই দুইটি পদক্ষেপ তাদের বিজনেসকে রীতিমত ট্রেন্ড হিসেবে প্রতিষ্ঠা করে ফেলেছে এবং ব্যবহারকারীদের কাছে গ্রহণযোগ্যতা অনেক বাড়িয়ে দিয়েছে। ব্র্যান্ড রিপজিশনিং ঠিক এভাবেই চলতি ব্র্যান্ডের জনপ্রিয়তা বাড়ায়।
২) সোশ্যাল মিডিয়া মার্কেটিং
সোশ্যাল মিডিয়া এখন শুধুমাত্র একটি পার্সোনাল প্ল্যাটফর্ম নয়, এটা কাস্টমার এনগেজ করার জন্য একটা ভালো স্পেসও। মানুষ সারাদিন যতটা সময় অনলাইনে থাকে, তার বেশিরভাগ সময়ই কাটায় সোশ্যাল মিডিয়ায়। টার্গেট অডিয়েন্স এর সাথে কানেক্ট করতে, সম্পর্ক ভালো করতে এবং তাদের মনে রাখার মতো ক্যাম্পেইন অ্যারেঞ্জ করতে সোশ্যাল মিডিয়ার জুড়ি নেই। নির্দিষ্ট অডিয়েন্সকে টার্গেট করে অ্যাড ক্যাম্পেইন, বুস্টিং, ব্র্যান্ড কন্টেন্ট, পোলিং ইত্যাদি আরো অনেক ভাবেই সোশ্যাল মিডিয়াকে বিজনেস এর গ্রোথে ব্যবহার করা যায়। এমনকি জরিপে দেখা যায়, প্রায় ৫৫% মানুষ বিভিন্ন ব্র্যান্ডের কথা সোশ্যাল মিডিয়া থেকেই জানতে পারে।
এক্ষেত্রে আমরা ‘ডাভ’ এর #showus ক্যাম্পেইন এর কথা বিশেষভাবে বলতে পারি। ২০১৯ সালে সৌন্দর্যের কোনো নির্দিষ্ট আকার বা রূপ নেই, এই মতবাদকে সামনে রেখে সোশ্যাল মিডিয়ায় ডাভ তাদের #showus প্রজেক্ট লঞ্চ করে। এই প্রজেক্ট ব্যাপক সফলতা পায়, হ্যাশট্যাগটি প্রথম বছরেই ফেসবুক, ইউটিউব ও টুইটার মিলিয়ে সাত মিলিয়নেরও বেশি বার ব্যবহৃত হয়েছিল। দুই হাজারেরও বেশি নারী এতে অংশ নিয়েছিলেন। সৌন্দর্য ট্রাডিশনাল ভিউকে ভেঙে ডাভ সরাসরি টার্গেট অডিয়েন্সের চাহিদা ও অনুভূতিতে পৌঁছাতে পেরেছে, এজন্য তাদের সোশ্যাল মিডিয়া মার্কেটিং কাজ করেছে।
৩) লয়ালিটি প্রোগ্রাম
নতুন একজন কাস্টমারকে আকৃষ্ট করার চেয়ে পুরাতন একজন কাস্টমারকে ধরে রাখা ব্যবসার জন্য বেশি লাভজনক। এছাড়াও এই স্ট্র্যাটেজি ঠিকভাবে কাজে লাগাতে পারলে পুরাতন কাস্টমাররাই নতুন কাস্টমার নিয়ে আসতে পারেন। রিপিট কাস্টমারদেরকে উপহার দেওয়া বা লয়ালিটি প্রোগ্রাম চালু করা ব্যবসার জন্য হতে পারে উপকারী। রেগুলার কাস্টমারদের এক্সক্লুসিভ ডিল অফার করা, ডিসকাউন্ট দেয়া বা নির্দিষ্ট পরিমাণ শপিংয়ে গিফট দেয়া এক্ষেত্রে বেশ ভালো কাজ করে। এছাড়াও পয়েন্ট সিস্টেম সাবস্ক্রিপশন সিস্টেম এগুলোও কাজে লাগানো যায়।
উদাহরণ হিসেবে আমরা দারাজ অ্যাপের কথাই বলতে পারি। দারাজে বিভিন্ন শপেই একটা নির্দিষ্ট অ্যামাউন্টের কেনাকাটার উপর কুপন দিয়ে থাকে। সেই কুপন ব্যবহার করে পাওয়া যায় ছাড়। এছাড়াও বিভিন্ন শপ তাদের ফলোয়ারদেরক বিভিন্ন এক্সক্লুসিভ ছাড় দেয়। এরপরেও রেগুলার কেনাকাটায় দারাজ অ্যাপ থেকে কয়েন বা পয়েন্ট সংগ্রহ করা যায়, যার দ্বারা পরবর্তী কেনাকাটায়ও পাওয়া যায় ছাড়।
৪) কন্টেন্ট বেজড মার্কেটিং
বর্তমানে মিডিয়ার কল্যাণে বিভিন্ন কন্টেন্ট তৈরি ও প্রচার বেশ জনপ্রিয়। কন্টেন্ট যেকোনো কিছুই হতে পারে, শর্ট ভিডিও, গল্প, গান ইত্যাদি। এখনকার যুগে ক্রেতারা শুধুমাত্র প্রোডাক্ট দেখে আকৃষ্ট হয় না। বরং অ্যাডভার্টাইজমেন্ট আর মার্কেটিং এ প্রোডাক্টের সাথে এমন কিছু যোগ করতে হয় যা ক্রেতার ভালো লাগবে অথবা মনে থাকবে। সোশ্যাল মিডিয়ায় বিভিন্ন কন্টেন্ট এই স্থান নিয়ে নিয়েছে বেশ আগেই। আপনার বিজনেসকে পরবর্তী ধাপে নিয়ে যেতে আপনিও কন্টেন্ট বেজড মার্কেটিং এর দিকে এগোতে পারেন।তবে কন্টেন্ট বেজড মার্কেটিং এর আইডিয়া কিন্তু নতুন নয়। অনেক আগে থেকেই পোস্টার, অ্যাড তৈরি, মিউজিক বা জিঙ্গেল এসবের ব্যবহার হতো। তবে এখন যুগের সাথে তাল মিলিয়ে কন্টেন্ট আরো এগিয়ে গিয়েছে।
উদাহরণ হিসেবে আমরা “রাঁধুনী” ব্র্যান্ডকে দেখতে পারি। রাঁধুনী কাজ করে বিভিন্ন গুঁড়া মসলা, তেল ও রেডিমিক্স মসলা নিয়ে। তাদের কার্যক্রম আগে শুধুমাত্র টিভিতে থাকলেও এখন তাদের অফিশিয়াল ফেসবুক পেজে তাদের মসলা ব্যবহার করে বিভিন্ন রেসিপি শেয়ার করা হয়, কুইজ আয়োজন করা হয় এবং বিভিন্ন দিবস বা অনুষ্ঠান উপলক্ষ্যে বিশেষ বিশেষ রান্নাও শেয়ার করা হয়। এর ফলে তাদের যেমন পরিচিতি বাড়ে, ব্যবসাও বিস্তৃত হয়।
৫) কোলাবরেশন প্রোগ্রাম
কোলাবরেশন কিন্তু কয়েকটা মার্কেটের কাস্টমারকে একইসাথে আনার খুব চমৎকার একটা উপায়। কোলাব এ দুই বা তার বেশি কোম্পানি একইসাথে নিজেদের প্রমোশন ও মার্কেটিং করে। সাধারণত আলাদা আলাদা প্রোডাক্ট নিয়ে কাজ করা কোম্পানি একসাথে কোলাবরেশন করে। যেমন- শাড়ি, গয়না আর মেকআপের শপ একসাথে, অথবা কুকওয়্যার, মসলা আর গ্রোসারি শপ একসাথে, অথবা ফুড ডেলিভারি কোম্পানি, রেস্টুরেন্ট, হোমশপ ইত্যাদি একসাথে। এতে ক্রেতা একইসাথে কয়েকটা চাহিদা পূরণের উপায় পেয়ে যায়, কোম্পানিগুলোও একে অন্যের কাস্টমার বেস এর মধ্যে নিজেদের প্রমোশন করতে পারে।
উদাহরণ হিসেবে আমরা স্পটিফাই এর সাথে উবার এর কোলাবরেশন এর কথা বলতে পারি। উবার রাইডে যেতে যেতে স্পটিফাই স্ট্রিমে গান শোনা— মূলত এই ধারণাকে সামনে রেখেই করা হয় স্পটিফাই উবার কোলাবরেশন। এতে দুই কোম্পানিই লাভবান হয়েছে এবং এদের মিউচুয়াল কাস্টমাররাও।
৬) প্রাইস অ্যাডজাস্টমেন্ট
মার্কেটিং এ ইনোভেশন এর আরেকটা উপায় হতে পারে প্রাইস অ্যাডজাস্টমেন্ট। প্রাইস অ্যাডজাস্ট অনেক কিছুর উপর নির্ভর করে, যেমন- কস্টিং, ম্যানুফ্যাকচারিং, এক্সট্রা বিল, অন্যান্য কম্পিটেটর কোম্পানির প্রাইস, কাস্টমার বেস এর ইনকাম রেঞ্জ ইত্যাদি। টার্গেট কাস্টমারের উপর প্রাইসিং অনেকটাই নির্ভর করে। এছাড়াও একটা নির্দিষ্ট কাস্টমার বেস এ আটকে না থেকে অন্য ইনকাম ক্লাসের কাস্টমারদের আকৃষ্ট করার জন্যও প্রাইস অ্যাডজাস্টমেন্ট করা হয়। যেমন- জুতার ব্র্যান্ড বাটাতে আলাদা আলাদা প্রাইস রেঞ্জ এর আইল করা থাকে। সেখানে একদম হাই এন্ড জুতা যেমন আছে, মিড বাজেট বা অ্যাফোর্ডেবল বাজেট এর জুতাও আছে। এভাবে প্রোডাক্ট-প্রাইস অ্যাডজাস্টমেন্ট করে কোম্পানিগুলো নিজেদের পরিধি বাড়াতে পারে এবং নতুন নতুন কাস্টমার আকৃষ্ট করতে পারে।
৭) টেকনোলজিক্যাল আপগ্রেড
টেকনোলজিক্যাল আপগ্রেড মূলত ফিজিক্যাল প্রোডাক্ট বা পণ্যের বদলে সার্ভিস বা অনলাইন প্রোডাক্ট নিয়ে কাজ করে। এটাকে সার্ভিস ক্যাটাগরিতেও পুরোপুরিভাবে ফেলা যায়। এই ক্ষেত্রে ব্র্যান্ড বা বিজনেস তাদের সার্ভিসকে অনলাইন নির্ভর করে যা কনভেনিয়েন্স বাড়ায় এবং কাস্টমারের সন্তুষ্টি বাড়ে। এটা বিভিন্নভাবেই হতে পারে, যেমন- মুভি, সফটওয়্যার ইত্যাদি।
উদাহরণ হিসেবে আমরা বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় অনলাইন বুকশপ রকমারি.কম এর কথা বলতে পারি। রকমারি মূলত বই ডেলিভারি করে, কিন্তু এখন কাগজের বইয়ের পাশাপাশি ই-বুকও সমান জনপ্রিয়। ই-বুক তৈরিতে রিসোর্স খরচ হয় না, এতে খরচ যেমন বাঁচে, পরিবেশেরও ক্ষতি কম হয়। রকমারি বর্তমানে বইয়ের পাশাপাশি যুক্ত করেছে ই-বুকও, যা কিনে আপনি মোবাইল ডিভাইস বা কিন্ডল রিডার এর সাহায্যে পড়া শুরু করতে পারেন। এটাকে টেকনোলজিক্যাল আপগ্রেড বলা যেতেই পারে।
৮) লাইফস্টাইল ব্র্যান্ডিং
এখন মানুষ শুধুমাত্র কোনো একটা প্রোডাক্ট কেনার চেয়ে সেই প্রোডাক্ট যে লাইফস্টাইল অফার করে তাতেই বেশি আগ্রহী থাকে। একটা প্রোডাক্ট শুধুমাত্র কিনে ব্যবহার করা নয়, বরং তাকে অনুভব করা এবং তার সাথে যে লাইফস্টাইল আসে তার সাথে যুক্ত হওয়াটাই মানুষের কাছে বেশি গ্রহণযোগ্য।
এক্ষেত্রে একটা বেশ ভালো উদাহরণ হতে পারে আড়ং। ব্র্যাক এর সিস্টার কোম্পানি আড়ং যখন শুরু হয়েছে তখন আড়ং এর বিশেষত্ব ছিল শুধুমাত্র পোশাক আর হোম ডেকর। বর্তমানে আড়ং জুতা, আসবাবপত্র, সব বয়সী মানুষের পোশাক, ডেইরি সেকশন, জুয়েলারি, স্কিনকেয়ার ও বিউটি এবং আরো অনেক প্রোডাক্ট লাইন এর সাথে নিজেদের সমৃদ্ধ করেছে। আড়ং এখন শুধুমাত্র একটি নরমাল শপ নয়, একটি লাইফস্টাইল ব্র্যান্ড এ পরিণত হয়েছে। এর ফলে আড়ং এখন সারাদেশের বিখ্যাত ও পরিচিত একটি নাম।
৯) ননপ্রফিট পার্টনারশিপ ও স্পন্সরশীপ
এই টেকনিক শুধু যে আপনার ব্যবসা বাড়াবে তা নয়, এর সাথে আপনার পাবলিসিটিও প্রচুর বাড়বে। ভালো কাজের অংশীদার হতে সবাই চায় এবং এই কাজে সংশ্লিষ্ট সবার জন্যই পাবলিসিটি গুরুত্বপূর্ণ। নন-প্রফিট অর্গানাইজেশনে স্পন্সর করে বা পার্টনার হওয়ার মাধ্যমে নেটওয়ার্কিং এর সুযোগও বাড়ে, বিভিন্ন প্ল্যাটফর্মের বিভিন্ন কাজের মানুষের সাথে পরিচয় হয়, যা ভবিষ্যতে কাজে লাগে। এছাড়াও ভালো কাজ করতে পারার আত্মতৃপ্তিতো সবার মাঝেই থাকে।
বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় অনলাইন ট্র্যানজেকশন কোম্পানি বিকাশ এর কথা এখানে বলা যায়। বিকাশ অ্যাপ্লিকেশন এ একটা আলাদা সেকশনই আছে ডোনেশন নামে, যেখানে ক্লিক করে ইউজাররা নিজেদের পছন্দমত বেশ কয়েকটি সমাজসেবামূলক প্রতিষ্ঠান যেমন- ব্র্যাক, শক্তি ফাউন্ডেশন, এসওএস চিলড্রেনস ভিলেজ, ফিলিস্তিন দূতাবাস ইত্যাদি প্রতিষ্ঠানে নিজেদের পছন্দমত অ্যামাউন্ট ডোনেট করতে পারেন। এর ফলে ইউজারদের আলাদা আলাদা করে নাম্বার নিয়ে ডোনেট করার ঝামেলা করতে হয় না।
শেষ পর্যন্ত আমরা এটাই বলতে পারি, মার্কেটিং ইনোভেশন একটা বিজনেস বা ব্র্যান্ডের একদম ফ্রন্টলাইন থেকে শুরু করে শেষ পর্যন্তও কাজ করে, আবার খুব সীমিত কাজ করেও সর্বোচ্চ ফলাফল দিতে পারে। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির এই আধুনিকতার যুগে সবকিছুতেই নতুনত্বের ছোঁয়া লেগেছে। মার্কেটিংএও তাই নতুনত্ব এনে নিজের বিজনেসকে পরের লেভেলে পৌঁছে দেয়া যায় খুব সহজেই। বিশ্বের বড় বড় ব্র্যান্ডগুলোর সাথে তাল মিলিয়ে মার্কেটিং কৌশল উন্নত করতে পারলেই বিজনেস সাকসেসফুল হয়ে উঠবে।