বইপ্রেমীদের রাজ্যে সব বই শুধু পড়ার বা জ্ঞানের উৎস নয় বরং কিছু কিছু বই সাহিত্য ও ইতিহাসের জন্যও অত্যন্ত মূল্যবান। কিছু বই যেমন অমূল্য সম্পদ, তেমন কিছু বই চোখের শান্তি। পৃথিবীতে নানা ধরনের বই আছে, আছে নানা ভাষার বই। এরই মাঝে কিছু বই আছে অত্যন্ত দুর্লভ, কিছু বই যেমন অত্যন্ত গোপনীয় তথ্য বয়ে বেড়াচ্ছে, তেমন কিছু বই ইতিহাসের কালের সাক্ষী হয়ে নিজেকে অত্যন্ত মূল্যবান হিসেবে উপস্থাপিত করেছে। এই লেখায় আমরা সময়ের ফাঁকে উঁকি দিয়ে দেখে নিব বিশ্বে অমূল্য কিছু বই আর জেনে নেব তাদের অসাধারণ কাহিনী।
বিশ্বের সবচেয়ে দামী ১০টি বই
১। কডেক্স লিসেস্টার- লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চি
অদ্ভুত হাস্যময়ী মোনালিসার চিত্রশিল্পী লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চি নিজেও কিন্তু বেশ রহস্যময় মানুষ ছিলেন। সাথে ছিলেন অত্যন্ত জ্ঞানী। জ্যোতির্বিদ্যায় ছিলো তার বেশ পান্ডিত্য। তিনি একাধারে ছিলেন লেখক, ইঞ্জিনিয়ার, চিত্রশিল্পী, গবেষক, বিজ্ঞানী, আর্কিটেক্ট, ভাস্কর ইত্যাদি নানা গুনে গুনান্বিত। কডেক্স লিসেস্টার মূলত তার বৈজ্ঞানিক গবেষণার ডায়রী।
আসল বইটি ৩০.৮ মিলিয়ন ডলার মূল্যে ১৯৯৪ সালে কিনে নেন বিশ্বের অন্যতম ধনকুবের বিল গেটস। ২০২১ সালে যার মূল্য ৫৪.৪ মিলিয়ন ডলার। কী আছে এই বইতে যা এটিকে এত মূল্যবান করে তুলেছে?
১৫১০ সালে লেখা এই বইটিতে আছে লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চির তৎকালীন লেখা, আঁকা, বিভিন্ন তত্ত্ব, বিভিন্ন বিষয়ের উপর বৈজ্ঞানিক গবেষণা যেমন- পানির গতিবিধি, চাঁদের উজ্জ্বলতার কম বেশি হওয়ার কারণ অথবা পাহাড়ে কেন সামুদ্রিক প্রাণীর জীবাশ্ম পাওয়া যায়- এ ধরনের বিষয়গুলোর ব্যাখ্যা। বৈজ্ঞানিক যুগের শুরুর দিকের এ সকল গবেষণা, তত্ত্ব নি:সন্দেহে অত্যন্ত মূল্যবান।
কেনার পর বিল গেটস এটির বিভিন্ন পেইজ ডিজিটালি স্ক্যান করেন এবং কিছু কিছু পাতা উইন্ডোজ ৯৮ এর ওয়ালপেপার ও স্ক্রিনসেভার হিসেবে প্রকাশ করেন।
২। দ্যা বুক অফ মরমন
বুক অফ মরমন এখন পর্যন্ত বিক্রি হওয়া সবচেয়ে দামী ধর্মীয় গ্রন্থ। এটির আসল মূল্য ৩৫ মিলিয়ন ডলার হলেও বর্তমানে এটির মূল্য দাঁড়াবে ৩৭.৩৫ মিলিয়ন ডলার।
২০১৭ সালে ৩৫ মিলিয়ন ডলারের বিনিময়ে দ্যা চার্চ অফ জিসাস ক্রাইস্ট অফ ল্যাটার ডে সেইন্টস এটির ১৮৩০ সালে হাতে লেখা কপিটির পান্ডুলিপি কিনে নেয়৷ এরপরে এটিকে প্রিন্ট করে এবং ডিজিটালি সবার জন্য সহজলভ্য করে।
৩। ম্যাগনা কার্টা
১৫ জুন, ১২১৫ সালে ইংল্যান্ডের রাজা জন দ্বারা স্বাক্ষরিত, বিভিন্ন অধিকারের রাজকীয় সনদ হলো এই ম্যাগনা কার্টা (মতান্তরে ম্যাগনা চার্টা)। এটিই প্রথম দলিল যা ঘোষণা করে যে, রাজা এবং তার সরকার আইনের উর্ধ্বে নয়। এর উদ্দেশ্য ছিলো রাজতন্ত্রকে তাদের ক্ষমতার শোষণ থেকে বিরত রাখা এবং রাজকীয় কর্তৃত্বের সীমাবদ্ধতা তৈরি করা।
কার্লাইল গ্রুপের সহ-প্রতিষ্ঠাতা ডেভিড রুবেনস্টেইন, ২০০৭ সালে এই ঐতিহাসিক নথিটি ২১.৩ মিলিয়ন ডলারে কিনে নেন যা বর্তমানে প্রায় ২৭ মিলিয়ন ডলার সমমূল্যের। তিনি নিশ্চিত করেন যেন ঐতিহাসিক এই নথিটি আমেরিকাতেই থাকে। আমেরিকান সরকার পরবর্তীতে অনেক আইন প্রয়োগের ক্ষেত্রে এই নথির দ্বারা প্রভাবিত হয়।
৪। দ্যা বে সাম বুক
“বে সাম বুক” যতটা না তার মাঝে থাকা উপাদানের জন্য বিখ্যাত তার চেয়ে বেশি বিখ্যাত এইজন্য যে, এটি ব্রিটিশ উত্তর আমেরিকার প্রথম মুদ্রিত বই। ১৬৪০ সালে মুদ্রিত এই বইটির মাত্র ১১টি কপি রয়েছে পুরো বিশ্বে, যা এটিকে দুর্লভ বইয়ের তালিকায় উপরে রেখেছে।
মূলত পিউরিটানিজম ধর্মের ধর্মীয় গানের লাইন সম্বলিত এই দুর্লভ বইটির একটি কপি ২০১৩ সালে ১৪.২ মিলিয়ন ডলারে বিক্রি হয়েছিলো। যা বর্তমানে প্রায় ১৬ মিলিয়ন ডলার সমমূল্যের। এই বইটিও বর্তমানে ডেভিড রুবেনস্টেইনের কাছে সংগৃহীত আছে। এটি তিনি মাঝে মাঝে বিভিন্ন লাইব্রেরিতে প্রদর্শনের জন্য দিয়ে থাকেন।
৫। বার্ডস অফ আমেরিকা- জন জেমস অডোবন
পাখিবিশারদ, প্রকৃতিবিদ এবং চিত্রশিল্পী জন জেমস অডোবন দেশীয় পাখির প্রজাতি ও অন্যান্য বন্যপ্রাণী নিয়ে অধ্যয়ন করতে পুরো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ঘুরে বেড়ান এবং তার ভ্রমণগুলোকে রেকর্ড করেন এবং দারুণ সব আকর্ষণীয় ছবি সংগ্রহ করেন।
১৮২৭ থেকে ১৮৩৮ সালের মধ্যে প্রকাশিত “বার্ডস অফ আমেরিকা” তে ৪৩৫ প্রজাতির উত্তর আমেরিকার পাখিদের হাতে আঁকা লাইফ সাইজ আকারের ছবি রয়েছে। ২০১০ সালে ১১.৫ মিলিয়ন ডলারে বিক্রি হয় এই বইয়ের একটি কপি, যার বর্তমান মূল্য প্রায় ১৪ মিলিয়ন ডলার। ৪টি ভলিউম সম্বলিত এই বইটির মাত্র ১১৯ টি কপি রয়েছে যার বেশিরভাগই বিভিন্ন জাদুঘর ও লাইব্রেরিতে সংরক্ষিত আছে।
৬। গুটেনবার্গ বাইবেল
১৪৫৫ সালে জোহানেস গুটেনবার্গের প্রিন্টিং প্রেসে মুদ্রণযোগ্য টাইপ করে প্রথম মুদ্রিত হয়েছিলো এই গুটেনবার্গ বাইবেল। গুটেনবার্গ বাইবেল রয়েছে ৪৯টি কিন্তু তার মধ্যে মাত্র ২১টি সম্পূর্ণ বাইবেল, বাকিগুলো অসম্পূর্ণ। এজন্যই এই বাইবেলগুলো এত বেশি দুর্লভ ও দামী।
১৯৮৭ সালে জাপানি বই বিক্রেতা কোম্পানি মারুজেন ৫.৪ মিলিয়ন ডলারে গুটেনবার্গ বাইবেলের অসম্পূর্ণ কপি কিনে নেয়, যা বর্তমানে প্রায় ১২.৪৩ মিলিয়ন ডলার। আপনি চাইলে অস্টিনের ইউনিভার্সিটি অফ ক্যালিফোর্নিয়াতে এই বাইবেলের একটি কপি দেখতে পারবেন।
৭। দ্যা ক্যান্টারবেরী টেলস- জেফরি চসার
১৩৮৭ থেকে ১৪০০ সালের মাঝে জেফরি চসার ২৪ টি গল্প, ১৭০০০ লাইনের গদ্য ও পদ্যের মাধ্যমে উপস্থাপন করেন “ক্যান্টারবেরী টেলস” নামক বইয়ে, যা মূলত একদল তীর্থযাত্রীদেরকে উদ্দেশ্য করে লেখা যারা লন্ডন থেকে ক্যান্টারবেরী ক্যাথেড্রালের উদ্দ্যেশ্যে রওনা করেন। মূলত ক্যান্টারবেরী টেলস পাঠদানের প্রতিযোগিতা হয় তাদের মাঝে এবং পুরস্কার হিসেবে ছিলো ফেরার সময় সাউথওয়ার্কের ট্যাবার্ড ইনে একবেলার খাবার।
এই ক্যান্টারবেরী টেলস এত বেশি দামী ও দুর্লভ হওয়ার কারণ পুরো পৃথিবীতে এটির ১৪৭৭ সালের প্রথম এডিশনের বই রয়েছে মাত্র ১২ টি। ১৯৯৮ সালে ব্রিটিশ ধনকুবের এবং জনহিতৈষী জন পল গেটি জুনিয়র এই ক্যান্টারবেরী টেলস এর ১৪৭৭ সালের বিরল এডিশনের একটি কপি কেনেন ৭.৫ মিলিয়ন ডলারে, যা বর্তমানে প্রায় ১৩ মিলিয়ন ডলার সমমূল্যের।
৮। দ্যা গসপেলস অফ হেনরি দ্যা লায়ন
বিল গেটস কোডেক্স লিসেস্টার কেনার আগে বিশ্বে সবচেয়ে দামী বই হিসেবে পরিচিত ছিলো “দ্যা গসপেলস অফ হেনরি দ্যা লায়ন”।
রাজা হেনরি দ্যা লায়ন ছিলেন জার্মানি প্রতিষ্ঠার একজন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্ব। ব্রান্সউইক ক্যাথেড্রালের ভার্জিন মেরীর বেদির উদ্দেশ্য রাজা হেনরি দ্যা লায়ন, ডিউক অফ স্যাক্সনির দ্বারা তৈরি করা হয়েছিলো। এটি রোমানেস্ক বইয়ের দারুণ একটি মাস্টারপিস এবং ধারণা করা হয় ১১৮৮ সালের দিকে প্রকাশিত হয়েছিলো।
১৯৮৩ সালে এটি নিলামের মাধ্যমে একদল দরদাতাদের কাছে বিক্রি করা হয়, যার মধ্যে জার্মানির ফেডারেল সরকারও ছিলো। ১১.৭ মিলিয়ন ডলারে বিক্রি হওয়া এই বইটির বর্তমান মূল্য প্রায় ৩০ মিলিয়ন ডলার। এটি উলফেনবুটের হারজোগ আগস্ট লাইব্রেরিতে প্রতি বছর ছয় সপ্তাহের জন্য প্রদর্শিত হয়ে থাকে।
৯। দ্যা সেন্ট কুথবার্ট গসপেল
ইউরোপিয়ান ইতিহাসের শুরুর দিকের সবচেয়ে পুরোনো, অক্ষত অবস্থায় পাওয়া বইটি হলো “দ্যা সেন্ট কুথবার্ট গসপেল”। এই গসপেলটি ৬৮৭ সালে এর লেখক সেন্ট কুথবার্টের সাথে সমাধিস্ত করা হয়। ১৩০ বছর পুরোনো বই হওয়া সত্ত্বেও এটি ভালো অবস্থায় পাওয়া যায় এবং এটির আকর্ষণীয় লাল বাঁধাই করা কভারটি পর্যন্ত অক্ষত আছে।
এই গসপেলটি ১১০৪ সালে সেন্ট কুথবার্টের কবর থেকে উদ্ধার করা হয়, যখন তার দেহাবশেষ পুরনো কবর থেকে মূলত একটি মন্দিরে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিলো। অনেকটা সময় পর্যন্ত এটিকে রক্ষাকবচ হিসেবে ব্যবহার করা হয়। এরপরে ২৫০ বছর ধরে এটি ব্যক্তি মালিকানাধীন ছিলো, ১৭ শতকের গোড়ার দিকে বেলজিয়ামের জেসুইট সম্প্রদায়কে এটি দান করা হয়।
২০১২ সালে ১৪ মিলিয়ন ডলারের বিনিময়ে এটি কিনে নেয় ব্রিটিশ মিউজিয়াম, যার বর্তমান মূল্য প্রায় ১৬ মিলিয়ন ডলার। এটির স্ক্যান করা ডিজিটাল কপি ব্রিটিশ মিউজিয়ামের অনাইন সাইটেও আপনি দেখতে পারবেন।
১০। শেরবোর্ন মিসাল
৩৪৭ টি ইলুমিনেটেড পৃষ্ঠা (ফুল, পাতা সম্বলিত বিশেষ ফন্ট দ্বারা লেখা) সম্বলিত ১৫ শতকের সবচেয়ে বড় মিসাল (ধর্মীয় বা উপাসনা গ্রন্থ) হলো শেরবোর্ন মিসাল। এটির ওজন প্রায় ২০ কেজি। এটি ডরসেটের শেরবোর্নে সেন্ট মেরির বেনেডিক্টাইন অ্যাবের জন্য তৈরি করা হয়েছিলো এবং খুব সম্ভবত শেরবোর্নের মঠ রবার্ট ব্রুইনিং দ্বারা এটি কমিশন করানো হয়েছিলো, যার কথা এটিতে ১০০ বারেরও বেশি উল্লেখ আছে।
১৩৯৯ থেকে ১৪০৭ সালের মাঝে তৈরি করা এই ধর্মীয় বইটি এখনো পর্যন্ত তার জৌলুসতা ধরে রেখেছে খুবই সুন্দর করে। ইংরেজ সভ্যতার গথিক পেইন্টিং এর আকর্ষণীয় উদাহরণ এই বইটিকে ২০০১ সালে একজন ব্যক্তিগত সংগ্রাহক ব্রিটিশ লাইব্রেরি কাছ থেকে কিনে নেন ২১.২১ মিলিয়ন ডলারের বিনিময়ে। যা বর্তমানে প্রায় ৩৪ মিলিয়ন ডলারের কাছাকাছি। এটি প্রায়ই ব্রিটিশ লাইব্রেরির রিটব্লাট গ্যালারিতে প্রদর্শন করা হয়।
বিশ্বের সবচেয়ে দামী বইগুলো যতটা না জ্ঞানের আধার, তার চেয়ে বেশি মানুষের ইতিহাস, সংস্কৃতির দুর্লভ সব ঘটনা ও কৃতিত্বের প্রতীক। হোক সেটা রেঁনেসা যুগের কোনো পন্ডিতের হাতে লেখা পান্ডুলিপি বা প্রিন্টিং জগতের সূচনার প্রমাণ- এ সকল দুর্লভ বইয়ের মূল্য আসলেই টাকার দ্বারা পরিমাপ করা যায় না। তাই এই দুর্লভ সাহিত্যের রত্নগুলোর সংগ্রাহকরা চেষ্টা করেন যেন এগুলো পরবর্তী সব প্রজন্মের কাছেও মানব ইতিহাসের অসাধারণ যাত্রার প্রমাণ হিসেবে থেকে যায়।